‘সুলতান’ হয়ে উঠা

এসএম সুলতান/ চিত্রশিল্পী: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

কয়েক বছর আগের এক সন্ধ্যায় নড়াইলে হাজির হয়েছিলাম আমরা দুই বন্ধু। রাতে থাকার ঠাঁই খুঁজতে একদম প্রাণ জেরবার অবস্থা। অনেক খোঁজাখুঁজির পর একটা হোটেলে হাজির হই। বেশ সস্তায় মিলল দুই বিছানার রুম। সম্ভবত ২৫০ টাকা। হোটেল মালিকের ভাবভঙ্গি বেশ অদ্ভুত। সব মিলিয়ে হরর অভিজ্ঞতা। সকালে বের হতেই আগের দিনের মতো সদর দরোজায় বসা হোটেল মালিক। কোথায় যাচ্ছি জিজ্ঞাসা করতে বললাম, এসএম সুলতানের বাড়ি দেখতে যাচ্ছি। মুর্হূতে তার চেহারা পাল্টে গেল। কোমল স্বরে জানালেন, সুলতান একজন কামেল আদমী। তার কাছে যেন আমরা কিছু চাই। তিনি ফেরাবেন না! সে যাত্রায় আমরা কিছু চাই নাই- কিন্তু ওই লোকটার কথা সুলতান প্রসঙ্গ আসলে এড়িয়ে যেতে পারি না।

ওই ঘটনার আগেও নড়াইলে এসেছিলাম সুলতানের ভিটায়। জলে টইটুম্বর খাল-বিল পেরিয়ে গিয়েছিলাম কবিয়াল বিজয় সরকারের বাড়ি। আর আমাদের সুলতান পরিচিতি মূলত আহমদ ছফার ‘যদ্যাপি আমার গুরু’ পড়ে। এছাড়া শাহাদুজ্জামানের নেওয়া দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। তার অদ্ভুত যাপনের কথা শুনেছিলাম। ছবিতে দেখেছিলাম বিচিত্র ধরনের পোশাক পরেছেন। কিন্তু কখনো এইভাবে ভাবি নাই যে সুলতানের কাছে কিছু চাওয়া যেতে পারে।

এই গল্প তখনই মনে পড়ল, যখন পড়ছিলাম ‘শিল্পি সুলতানের আত্মকথা: জীবনের জলরঙ’ বইটি। সাংবাদিক মহসিন হোসাইন সুলতানের জীবদ্দশার শেষ দিকে বইয়ের কথাগুলো লিপিবদ্ধ করেছিলেন। যা প্রকাশ হতে হতে কয়েক দশক লেগে গেছে। কেন লেগেছে? তাও আছে বইয়ের ভূমিকা অংশে। সে যাই হোক, দীর্ঘ সময় হলেও সুলতানের মুখে তো তার জীবন শোনা গেল।

বইয়ের ভূমিকায় সুলতানের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাজ ও সম্পর্কের অভিজ্ঞতা শোনাতে গিয়ে মহসিন লেখেন, “জীবনের এক বেলায় প্রায় এক দশক ধরে আমি কবিয়াল বিজয় সরকারের দলে বাঁধনদারের (গান রচনার) কাজ করেছি। সুলতান ভাই ঐ কবির দলের বাঁশিওয়ালা ছিলেন। এই কাজের জন্য আমরা দুজনই অর্থ পেতাম।” বোঝা যায়, তাদের অন্তরঙ্গতা কতটুকু। এই জায়গায় আমার নজর কেড়েছিল অন্য একটি প্রসঙ্গ। কবিয়াল বিজয় সরকারের বিচ্ছেদের বাইরেও অন্য গল্প শুনেছিলাম তার বাড়িতে বসে। যাকে বলা যায়- অলৌকিক ঘটনা। তিনিও যেন তেমন মানুষ- যার কাছে কিছু চাওয়া যায়। অনেকে নাকি চাইও। যদিও বিজয় সরকার ও সুলতানের সখ্য নিয়ে কোনো গল্পে এই বইয়ে নেই। তবে বংশীবাদন কী করে একটি মানুষের আত্মার সঙ্গে মিশে গেছে তার খণ্ড খণ্ড চিত্র তো আছে। সেখান থেকে বোধহয় বংশীবাদনরত সুলতানের একটা অর্থ দাঁড়ায়। এমনকি বেশভুষার জন্য। যার সঙ্গে যাপন ও ধারণের সম্পর্ক স্পষ্ট।

সুলতানের আঁকাআঁকি নিয়ে বোদ্ধার নানান মত আমরা ইতিমধ্যে নানাভাবে জেনেছি। সুলতানও কিছু সাক্ষাৎকারে তা খোলাসা করেছেন। এই বইয়ে তার অল্প-বিস্তর আছে। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো- সুলতান কীভাবে নিজেকে নির্মাণ করেছেন। ‘নির্মাণ’ এই অর্থে যে সেই কৈশোরেই তিনি বুঝতেন পারেন জীবনের অভিমুখ। সে পথে হেঁটে গেছেন। নড়াইলের ছোট্ট গ্রাম থেকে কলকাতা। তারপর ব্রিটিশ ভারত চষে বেড়িয়েছেন। কখনো জেলেদের পল্লীদের ছিলেন, নাম গোপন করে ছিলেন পুরীতে।  এরপর  তাজমহল, নিজামুদ্দীন আউলিয়ার দরগা, দেরাদুর, অমৃতসর, কাশ্মির, লহোর হয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য কত গল্প। ঢাকায় থিতু হননি ফিরে গেলেন নড়াইলে। সামাজিক-ধর্মীয় পরিচয়ে অন্ত্যজ জনের কাছে। তাদের মাঝেই ‘বোহেমিয়ান’ সুলতানকে মিলত।  আর এইকালে আত্মস্মৃতি পড়ে কী একটা সূত্রে যেন আটকে যায় এই পাঠক।

বইয়ের প্রচ্ছদ থেকে এসএম সুলতান/ চিত্রশিল্পী: নাসিম আহমেদ

বইটিতে সুলতান শিল্পী হয়ে ওঠার পর্যায়টি সুস্পষ্টভাবে কোনো একটি পর্বে তুলে ধরেননি। তবে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনায় টুকরো টুকরো গল্পে আমরা খানিকটা ধরতে পারি। তা যেমন ‘আদম সুরত’-এর আবির্ভাব, তেমনি সর্বশ্বেরবাদী ধারার মধ্যে নিজেকে বিলোপ করা। সৃষ্টি ও স্রষ্টা আলাদা নয়, পরমসত্তার মাঝেই সবকিছু বিরাজ করে।

এর প্রারম্ভিক সূত্র মেলে ‘প্রকৃতির মায়া’ শীর্ষক অংশে। যেখানে সুলতান বলছেন, “নানার বাড়ির কাছের সেই বিল, শাপলা, ধান, পাটবন, পাট বাছা, পাট শুকানো, পাট নিড়ানো, শুকনার সময়ের কৃষকের চাষাবাদ-জমি নিড়ানো, ধান রোয়া, ধানকাটা, ধানমাড়াই, ধানভানা আমি কোনোভাবেই ভুলতে পারিনি। সুদূর সিমলা, কাশ্মির, লাহোর, শিয়ালকোট, করাচি, লন্ডন, আমেরিকায় গিয়ে চাঁচুড়ি-পুরুলিয়ার মাঠে-বিলের সৌন্দর্যের রেণু ছড়িয়ে এলাম। এটা চাঁচুড়ি-পুরুলিয়া বিলেরই দৃশ্য নয়, সারা বাংলাদেশ ঘুরলে এমন দেখতে পাবেন। বাংলার প্রকৃতির মধ্যে কোনো উদাসীনতা নেই- যা আছে তাহলো মায়াবী আকর্ষণ। এই প্রকৃতির মায়া যার মনে রয়েছে তার তো কৃত্রিম কোনো কিছুর কাছে যাওয়ার দরকার নেই।” (পৃ: ২২)

“আমার বোধের ভিন্নতা কোথায়? আপনি বললেন, আমার ‘স্কুল অব থট’। আমার স্কুল তো খোলা প্রান্তর, কৃষকের ছোনা ঘরের বারান্দায় লুক্কোটানা চাষী, পাশে ঘুমন্ত বিড়াল, উঠানে অবসন্ন ক্লান্ত কুকুর। লাউ গাছের ঝুলন্ত লাউ, কৃষক বধূর নিকানো চুলোর পাশে রান্নার আয়োজন, বিলের থেকে ধরে আনা মাঝ বটি দিয়ে কাটা, বিকেলে গ্রাম্য বধূদের চুলবিলি দেয়া আর সেই সাথে আয়েস করে কিছুটা গল্পবলা। প্রকৃতি, মানুষ, মানুষ-প্রকৃতির গভীরে যা কিছু আছে সবি আমার ভূমিতে এসেছে। আমার ব্রাশ কোনোভাবেই ব্রিটিশের কৃত্রিম বোহেমিয়ার প্রশ্রয় নেই।” (পৃ: ১৪৫)

আর্ট কলেজে বরাবরই প্রথম হওয়া ছেলেটি- যে কিনা সবার চোখে বিস্ময়। হুট করে সব বাদ দিয়ে বের হলেন দেশ দেখতে। কোনো মায়া তখন তাকে বেধে রাখতে পারেনি। বইটি পড়তে পড়তে অদ্ভুত মনে হতে পারে! কোথাও থাকছেন না সুলতান। মায়া জাগছে মনে। এমন সময় সুলতান এক ঢেরা পরিবর্তন করছেন। একেক জন মানুষের সঙ্গে থাকছেন আবার তাকে ছেড়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কখনো বাবা বা সৎভাইকে ভোলেননি। কখনো ভোলেননি নিজ অঞ্চলের মানুষদের। সেখানকার শিশু-কিশোরদের জন্য গড়তে চেয়েছিলেন বিদ্যালয়- একদম সহজিয়া ধাঁচের। সেখানে ধাক্কা খান।

সুলতানের জীবনকাল খুবই চমক জাগানিয়া। কাঠমিস্ত্রীর ছেলে তিনি। শৈশবে হারানো মায়ের নাম জানা হয়নি কখনো। নড়াইলের জমিদার বাড়ির সুবাদে আর্ট কলেজে পড়ার জন্য কলকাতায় পাড়ি। এর আগে মাদ্রাসায়ও পড়েন কিছুদিন। ভালোবেসে ফেলেন মাদ্রাসা শিক্ষকের মেয়েকে। তার বিয়ের কারণেই কিশোরী সুলতান, যিনি তখন লাল মিয়া এলাকা ছাড়তে চান। কলকাতায় যাওয়ার পর আনুকূল্য পান শহীদ সোহরাওয়ার্দীর। যিনি রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাই। এই পরিবারের সঙ্গে সুলতানের সম্পর্ক খুবই অন্তরঙ্গ। নড়াইলের জমিদার ও সোহরাওয়ার্দী পরিবার সম্পর্কিত বয়ানগুলো উল্লেখযোগ্য। কারণ, তার বয়ানে সে সময়ের উচ্চবিত্তের একটা প্রাঞ্জল ধরা পড়ে। নড়াইলের জমিদার পরিবার সম্পর্কে জানাতে গিয়ে সুলতান যেমন তাদের শিল্প অনুরাগে পরিচয় তুলে ধরছেন, প্রজা বাৎসল্যের কথা বলছেন। একইসঙ্গে বলছেন, তাদের জীবিকা মূলত ‘প্রজা শোষণ’। একইভাবে স্বাধীন পাকিস্তানের শিল্প সংস্কৃতি যাদের হাত গড়ে ‍উঠা তাদের সঙ্গে একটা বর্ণনা পাওয়া যাবে। বিশেষ করে লহোরে একদল বাঙালি শিল্পরসিকের একত্রিত হওয়া নজর রাখে। যাদের কেউ কেউ পড়ে ইউরোপে যান। ঢাকায় ফিরে এই দেশের শিল্প-সংস্কৃতিতে ঋদ্ধ করে। তাদের কিছু বর্ণনা মুর্তজা বশীরের স্মৃতিধর্মী লেখায় পাওয়া যায়। অন্যরাও হয়তো লিখেছেন। সুলতানও একটা স্পষ্ট বর্ণনা দেন। তবে এই স্মৃতিকথার উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো- বহুমাত্রিক স্বভাবের কারণে সুলতান শুধু চিত্রশিল্প নিয়ে হাজির হন নাই ব্রিটিশ-ভারতের নানান অঞ্চলের মানুষ, তাদের জীবনবোধ, দর্শন, শিল্পবোধ- সর্বোপরি একটি মানবিক দলিল তুলে ধরেন। এমনকি সুলতানের নিজের দিকে চোখ ফেরালেও বারবার সেই বিষয়টা চলে আসে। কোনো খ্যাতি তাকে ধরে রাখতে পারে না। তিনি বরাবরই প্রান্তিক মানুষের কাছে ফিরে এসেছেন, তাদের সঙ্গে থেকেছেন, তাদের চিন্তা-ভাবনা ভাগাভাগি করেছেন। যা তার সর্বশ্বেরবাদী দৃষ্টিকে পুষ্ট করেছে।

প্রকাশনার দিক থেকে ‘শিল্পি সুলতানের আত্মকথা: জীবনের জলরঙ’ আরও উৎকর্ষতর হতে পারতো। এর প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে বাঁধাই-সাজসজ্জা কোনোটিই মানসম্পন্ন মনে হবে। বইটি পড়তে পড়তে মনে হবে অনাদরে পড়ে থাকা একটি রত্ম ভাণ্ডার উন্মোচন করছি। তার পরতে পরতে রয়েছে এমন রশ্মি যাকে কোনো আধারই ঢাকতে পারে না। সুলতান আত্মজীবনীতে অনেক অনাদার ও অবহেলার কথা বলেছেন। যা কিনা পেয়েছেন ঢাকার বিদগ্ধ সমাজে। তেমনই এই বই। তার মতো অমোছনীয় হয়তো বা। এই যে ‍সুলতানের নিজের কথা!

শেষে ওই বইয়ের অন্তিম পৃষ্টা থেকে আরও কিছু লাইন- “কী যে এক যন্ত্রণার মধ্যে আমি জন্ম নিয়েছিলাম তা কোনোদিন কোনোভাবে প্রশমন হয়নি। সেই তরুণ বয়সে সারা ভারত ঘুরলাম, কাশ্মির, পাকিস্তান, আমেরিকা, ব্রিটেন কোথাও আমার ঠিকানা হলো না, যন্ত্রণার প্রশমন হয়নি। সেই গোপন যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাইনি কোনোদিন। চিত্রাতীরের নিঝুম গ্রামগুলো আর তাদের হাতছানিতে কোথাও কোনোভাবেই কালি ফেলতে পারলাম না। ছুটে যাই নিজ চিন্তা আর স্বপ্নের ভূমিতে। কিছুই যেন থাকতে চায় না, সবি দূরে চলে যেতে চায়। শেষের বাঁশি শুনতে চাই না।” (পৃ: ১৭৬)

শিল্পি সুলতানের আত্মকথা: জীবনের জলরঙ কিনতে পারেন রকমারি ডটকম থেকে। লিংক

Comments

comments

2 thoughts on “‘সুলতান’ হয়ে উঠা

  1. বাংলাদেশের প্রখ্যাত শিল্পী এসএম সুলতান সম্পর্কে অনেক অজানা কথা জানা গেল। আসলে সৃজনশীল ব্যক্তিরা এমনই হয়। কোন শেকলে তাদের বাঁধা যায় না।

    • ধন্যবাদ। বইটি পড়তে পারেন। অনেক কিছু জানার আছে।

Comments are closed.