বিভ্রমে ঢাকা ঢাকা

ঢাকায় শীত কয়দিন থাকে? বাহারি অথবা ধূসর শীতের পোশাক নামাতে নামাতেই উড়ে যায় উত্তুরে হাওয়া। তারপর আরও কিছুদিন থাকে হিমের স্মৃতি। সেই শহরে এক শীতে শেয়ার বাজারে ধস নামে, শাহবাগে ফাঁসি ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না, বিশ্ববিদ্যালয় হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়, সাজ্জাদ সর্বস্বান্ত হয় আর এর সাথে জড়িয়ে পড়ে রেহেনা-মাইকেল ও অন্যদের জীবন। আর হ্যাঁ, সাজ্জাদই এখানে প্রধান চরিত্র। সে-ই ঢাকা। যে পালাতে চায়।

আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’ দেখতে দেখতে আমরা ভাবি ছবিটি দেখছি সাজ্জাদের দৃষ্টিকোণ থেকে। আসলেই?

এক শীতের এত এত ঘটনা এই সিনেমার গল্প বয়ানের গুরুত্বপূর্ণ দিক। ধূসর বর্ণের এ ছবির নির্মাণ ভঙ্গি ও গল্প একটা সরলরৈখিক বাস্তবতার ইশারা দেয়। যেন বলে- ওহ! সত্যিই তো! হ্যাঁ এই পথে আমরা সবাই হেঁটেছি। এর সবই ঘটে, আমরা তার সাক্ষী। এটা বোধ হয় একটা ফাঁদ। এই ফাঁদ হলো চেনা পথের হেঁটে যাওয়ার ফিল গুড অনুভূতি। সেই দুঃখ আর নাটকীয়তা। কিন্তু তা বোধ হয় না।

সময়কে আমরা যেভাবে অনুভব করছি। শনিবার, রবিবার বা সোমবার এই ধারাক্রমে যা ভেঙে দেয় এই ছবি। বরং দেখাতে চায় এই শহরে যখন এতগুলো ঘটনা একসাথে ঘটে তখন সাজ্জাদ এই ঘটনাগুলোর বাইরে আর ভেতরে কেমন? এগুলো কোনো ধারাবাহিকতা অনুসরণ না করেই আঘাত করে। আবার দেখেন ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’র রিভিউগুলোতে যে বিতিকিচ্ছিরি ঢাকার বয়ান সেটা কিন্তু দৃশ্যত ছবিতে অনেক ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। বরং নেতিবাচক মন ঢাকাকে আপন করতে না পারাই কনফেশন করছে। তাইলে এই শহর কার জন্য? কাকে নিয়ে বাঁচবে? এরা এই শহরে কেন থাকে?

এই গিঞ্জিময় শহরে সাজ্জাদ গাড়ি নিয়ে চলছে প্রায়ই একা, এমন এমন রাস্তায় চলছে যা জনবিরল। এমনকি বস্তিও প্রায় খালি। এটাও ফাঁদ। দৃশ্যটাকে কথিত বাস্তবতার বিচারে যখন দেখছেন এটা অসম্ভব। কিন্তু একটা দুনিয়া যদি আমার কোনো ভাবের লগে না মিলে, অস্বস্তি যোগায়- রাস্তায় অসংখ্য মানুষ থাকলে কী, আর না থাকলেই কী? বরং আমার নিঃসঙ্গতা আরও বাড়ে। এটাও ঠিক এমন কল্পনার জগতে আমরা অষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছি- যেখানে কেউ কারো নয়। তাই রাস্তার ভিড়-ভাট্টা বড় জোর ইকো টুরিজমের বাসনা যোগাতে পারে। ‘চলো না ঘুরে আসি অজানাতে’। কিন্তু কয়দিনের জন্য? মানুষে মানুষে মিলে যে সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম, যৌথতা অথবা মানুষের ইতিহাস তার জন্য অর্থবোধক নয়। যেহেতু আমরা সাজ্জাদে কোনো আদর্শ আরোপ করি না বা অরাজনৈতিক-স্বার্থপর আত্মার মানুষ- সেইখানে অপরাপর মানুষ বাহুল্য বটে। বরং যখন আমি ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’র, গল্প আমার। তখন আমি ফাঁদে কবুল করে নিই- আমি জানি আমি কতটা অর্থহীন!

আবার দেখেন সেই বাহুল্যহীন জগতে হঠাৎ হঠাৎ কারা যেন ঢুকে যাচ্ছে। যেন ঘটমান বর্তমানের সঙ্গে যখন কানেক্ট করা যায় না- ঢুকে যাচ্ছে ভূতুড়ে কিছূ চরিত্র। কারা যান নির্জন গলিতে সাজ্জাদের অনুসরণ। হঠাৎ করে তার গাড়ির পেছনে সিটে হাজির হয় এক কিশোরী, বিআরটিসি বাসে এক আগন্তুক বা মালয়েশিয়ান তরুণী। এমনকি ছবির গতি বা কাহিনীর সঙ্গে একদম সম্পর্কহীন মনে হয় রাশিয়ার কিছু স্থির দৃশ্য। আর শেকল বাধা কারো মুখোমুখি হয় সাজ্জাদ। এই পাগলটা কি সাজ্জাদ নিজে? কিন্তু এইসব কিছু অস্থির অস্তিত্বের অর্থহীনতার মধ্যে অর্থবোধক হওয়ার প্রাণপন চেষ্টা হিসেবে হাজির যেন! এবং আগে অর্থহীনতা, থেকেও না থাকাকে ব্যাখ্যা করুন- তারপর অন্য কিছু। সেটা সাজ্জাদও না, ফাঁদে আটক দর্শকরাও। যেহেতু তারা ইতিমধ্যে নিজেকে সাজ্জাদের জায়গায় বসিয়ে ব্যর্থতা ঢাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।

লাইভ ফ্রম ঢাকা [ Live from Dhaka ]
পরিচালক: আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ
চিত্রপরিচালক: তুহিন তমিজুর । শিল্প নির্দেশক: উজ্জ্বল আফজাল
অভিনয়ে: মোস্তফা মনোয়ার, তাসনোভা তামান্না, তানভীর আহমেদ চৌধুরী, মোশাররফ হোসেন, শিমুল জয়।
দৈর্ঘ্য: ১ঘন্টা ৩১ মিনিট।

এ যেন এমনভাবে কথা বলছে- আপাত পরিচিত দৃশ্য, পরিচিত চরিত্র অথবা পরিচিত ঘটনা কোনো এক কসমিক লেভেলে সব খোলস ভেঙে গড়িয়ে পড়ে নতুন দৃশ্য তৈরি করছে। হ্যাঁ, এটা আমার প্রশ্ন- সেই রূপান্তর যদি নতুন কোনো দৃশ্য হাজির না করে বা পুনঃপুনঃ আশাহীনতা বা আমরা বুঝতে পারি নতুন দিনের কথা বলছে যা নিছক আপাত নিস্ফল সমাধানের চেষ্টা, তবে রূপান্তরের ভেতর আর হাজির হই কেন? কেনই বা একাত্মবোধ করি। হয়তো ব্যক্তির এই অন্তর্গত বয়ান কোনো বাহ্যিক দৃশ্যসজ্জায় ধরা পড়ে না- এই কারণে হয়তো অপরাপর মানুষের মতো সাজ্জাদ শেষ পর্যন্ত অবোধ্য থেকে যায়।

সেখানে একই শীতে ঘটে যাওয়া অনেকগুলো ঘটনা একইসঙ্গে হাজির হয় অর্থ-অর্থের যোগফল হিসেবে। যেখানে ইতি-নেতির ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা একসঙ্গে জড়িয়ে থাকে। সেখানে শেয়ার বাজারের ধস বা শাহবাগের ফাঁসির রব বা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি কোনটাই পরস্পরকে এড়িয়ে যেতে পারে না। এখন এর যেকোনোটায় যুক্ত না হয়েও আপনি এর শিকার হতে পারেন। কোনো কিছু না দেখে, না শুনেও এর ভিকটিম হতে পারেন। এই বিভ্রম আমরা কীভাবে কাটাবো? এই প্রশ্ন আমাদের প্রত্যেকের হতে পারে। যেহেতু প্রশ্ন তত জোরালোভাবে তুলতে পারি না- তাই সাজ্জাদের উম্মূল অবস্থা দেখে বাস্তবের সাথে মেলাতে থাকি এবং ছবির শেষে এসে ধাক্কা খাই। আর বিভ্রম ঘটে বাংলাদেশের ঢাকা নামের এক জনপদে। যার অনেক কিছু জানেন বলেই আপনি জানেন। আসলেই কি জানি? আর হয়তো বড় পরিসরে ঢাকা স্রেফ নামডাক। যেখানে মানুষ জানে না কী হতে চায়, অথবা যা হয় তা সে বুঝে না, অথবা মানুষ যা হতে চায় সে আসলে তাই হয়ে আছে। আর ছোট পরিসরে ঢাকা। তাই বিভ্রমে ঢাকা ঢাকা।

Comments

comments