উকিল ও কামালের ‘নাইওর’ তর্ক

এক.

‘আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে’ খুবই জনপ্রিয় একটি গান। এই গানটি বারী সিদ্দিকীর কণ্ঠে হুমায়ূন আহমেদ তার পরিচালিত ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ (১৯৯৯) চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেন। তার পরপরই সারা বাংলার মানুষের হৃদয় জয় করে নেয়। এই পরিচিতি যেমন নেত্রকোনা অঞ্চলের সীমানা পার হয়েছে, একইসঙ্গে বিভিন্ন শ্রেণীর শ্রোতার কাছাকাছি পৌঁছেছে। তবে এর আগে গানটি বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের গণমানুষের কাছে পরিচিত ও কাছের হয়ে ওঠে। গানটির বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি বা আরও বেশি হতে পারে। এর জনপ্রিয়তার একটা দিক হতে পারে গানের বাণী ও সুর মানুষের চিরায়ত বিরহবোধের কাছাকাছি-জাগতিক ও পরমাত্মিক দ্বৈততার যুগল প্রকাশ। অন্যভাবে চিন্তা করলে একই মানুষের সরলরৈখিক যাত্রার সরল প্রকাশ যেন। এই ছবিতে গানটির গীতিকার হিসেবে উকিল মুন্সীর (১৮৮৫-১৯৭৮) নাম ব্যবহার করা হয়। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গানটির ব্যাখ্যা শুনেছিলাম উকিলের পুত্রবধূর কাছে।

২০১৩ সালে উকিলের মৃত্যুবার্ষিকীতে মন চাইছিল উকিলকে নিয়ে কিছু একটা লিখি (যা আলোকিত বাংলাদেশে প্রকাশিত হয়)। বিষয় নির্ধারণ করলাম উকিলের মৃত্যুচিন্তা বা প্রত্যাবর্তন। নির্ধারিত বিষয়ই আমাকে নিয়ে আসে বিখ্যাত এ গানের দুয়ারে। যেখানে কার্তিক নিয়ে চিন্তার দেখা মেলে। বাংলা অঞ্চলের ভাব রসে কার্তিকের যে মহিমা এই গানে সেই আর্তি আছে। গানের মূল বিষয় হলো নাইওর, যা খুবই প্রতীকী অর্থে ধরা দেয়।

বাড়ির উঠানে বড়ই গাছের নিচে দুটি কবর। কাচা-পাকা বড়ইয়ের ভারে গাছটি নত। উকিল মুন্সীর পাশে তার ছেলে সাত্তার মিয়ার কবর। তিনিও বিখ্যাত কবি ও গায়ক ছিলেন।

বাড়ির উঠানে বড়ই গাছের নিচে দুটি কবর। কাচা-পাকা বড়ইয়ের ভারে গাছটি নত। উকিল মুন্সীর পাশে তার ছেলে সাত্তার মিয়ার কবর। তিনিও বিখ্যাত কবি ও গায়ক ছিলেন।

সে সময় ইন্টারনেটে খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে একটা মজার ও অস্বস্তিকর বিষয়ের হদিস পাই। মজার এই কারণে যে যদি খবরটা সত্যি হয়, পুরোপুরি ভুল মানুষকে রেফারেন্স করে কাজ করছি। আর অস্বস্তি হলো লেখা ততদিনে তৈরি হয়ে গেছে এবং তথ্যটা সত্য হলে কারও প্রতি জুলুম করা হচ্ছে। তথ্যটা হলো এই গানের গীতিকার হলেন সুনামগঞ্জের প্রয়াত কামাল উদ্দিন বা কামাল পাশা।

যাই হোক, গানের বিতর্ক নিয়ে এ লেখায় সামান্য কিছু কথা তুলব, যা কোনোভাবে তুল্য বিচার না, এমনকি কে আগে গান লিখেছেন তার অনুসন্ধানও নয়। শুধু গানের বিতর্ক থেকে বাংলা ভাব গান সম্পর্কে কী কী প্রশ্ন আসে তা তুলে ধরা হলো। বলা ভালো সেটা অভিনব কোনো বিষয় নয়। এ প্রশ্ন আপনাদের অনেকের মাথায়ও আছে। তারপরও মনে করিয়ে দেয়া আরকি!

ডেইলি সিলেট ডটকম নামের নিউজপোর্টালে প্রকাশিত একটি খবরের শিরোনাম ছিল, ‘কামাল পাশার গান উকিল মুন্সীর ভণিতায় প্রকাশের প্রতিবাদ’। সেখানে বলা হচ্ছে, “নেত্রকোনা জেলার দক্ষিণ নাগড়া নিবাসী মাহবুব কবির কর্তৃক সংগ্রহ ও সম্পাদিত এবং ঢাকার বাংলাবাজারের ৬৮-৬৯ প্যারীদাস রোড, রুমি মার্কেটস্থিত ঐতিহ্য প্রকাশনা থেকে ফেব্রুয়ারি ২০১৩ইং সালে প্রকাশিত ‘উকিল মুন্সির গান’ নামক সংগ্রহ গ্রন্থের ১০টি গানের ওপর তীব্র আপত্তি উত্থাপন করেছে বাউল কামাল পাশা স্মৃতি সংসদ, সুনামগঞ্জ।”

আরও বলা হয়, প্রকাশিত গ্রন্থটির গানগুলোর শিরোনাম হচ্ছে ৩৪ পৃষ্ঠার ৪নং গান ‘আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানিরে ও পানি পূবালী বাতাসে’ ৩৭ পৃষ্ঠার ১০নং ‘ভাইটাল তরী কে যাও বাইয়ারে’ ৪৩ পৃষ্ঠার ২০নং গান ‘দুঃখীনির বন্ধুরে, অভাগিনীর বন্ধুরে’ ৪৪ পৃষ্ঠার ২১নং গান ‘আমার বাড়ি আসতে যদি দুঃখ পাও রাঙ্গা পায়’ ৬৭ পৃষ্ঠার ৬৪নং গান ‘সখীগো না জানিয়া করলাম পিরীতি’ ৭৬ পৃষ্ঠার ৮০নং গান ‘তুই যদি আমার হইতিরে ও বন্ধু আমি হইতাম তোর’ ৮৭ পৃষ্ঠার ১০৫নং গান ‘একদিন দেখা দিওরে বন্ধু একদিন দেখা দিও’ ৮৯ পৃষ্ঠার ১১০নং গান ‘আমার প্রাণবন্ধু আসিয়া, আমার দুঃখ দেখিয়া’ ১৩৪ পৃষ্ঠার ১৯৫নং গান ‘নবীজির খাসমহালে যাবে যদি’ এবং ১১৭ পৃষ্ঠার ১৬৩নং ‘ভেবেছিলাম এই রঙ্গে দিন যাবেরে সুজনও নাইয়া’ ইত্যাদি।

একই তথ্যের বিস্তারিত দেখা মেলে আল-হেলালের নেয়া গীতিকবি আবদুল ওয়াহিদের সাক্ষাৎকারে। সেখানে বলা হচ্ছে, ‘আষাঢ় মাসের ভাষা পানিরে ও পানি পূবালী বাতাসে বাদাম দেখে চাইয়্যা থাকি আমার নি কেউ আসেরে, কোনোদিন হইবে সেইদিন/নয়নের জল বন্ধে মুছিয়া নিবে/বলো কোনদিন আমার সেইদিন হইবে, হরদমে ইয়াদ রাখোহে বান্ধা ইয়া মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহ ইত্যাদি গান বারী সিদ্দিকী পিতাপুত্রের (উকিল মুন্সী ও আবদুস সাত্তার) নামে গেয়েছেন। অথচ এ গানগুলোর গীতিকার উকিল মুন্সী বা ছাত্তার এই মর্মে এখন পর্যন্ত কোনো বই প্রকাশ হতে আমি দেখিনি। কোনো বিচার-বিশ্লেষণ না করেই হুমায়ূন আহমেদ তার ছবিতে কামাল বিরচিত গানগুলো উকিল মুন্সীর নামে প্রচার দিয়েছেন। অনুরূপভাবে জালাল কবিরের ছেলেরাও কামালের গান তাদের পিতার নামে প্রকাশ করে যাচ্ছেন।’

জালাল উদ্দিন খাঁ থেকে শুরু করে দুর্বীন শাহ পর্যন্ত অনেকের নাম এ অভিযোগে রয়েছে। এখানে আল-হেলালের লেখা বই থেকে কামাল উদ্দিনের পরিচয় দেয়া যাক। তার দেয়া পারিবারিক পরিচয়টা এরকম-বাউল কামাল উদ্দিন ১৯০১ সালের ৬ ডিসেম্বর তৎকালীন সুনামগঞ্জ মহকুমার দিরাই থানার ভাটিপাড়া গ্রামে তালুকদার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আজিম উদ্দিন, মাতার নাম আমেনা খাতুন ডাক নাম ঠান্ডার মা। ইংরেজি ১৯৮৫ সাল বাংলা ১৩৯২ সালের ২০ বৈশাখ শুক্রবার রাত ১২টায় নিজ বাড়িতে তিনি ইন্তেকাল করেন। অর্থাৎ, তিনি উকিল মুন্সী ও রশিদ উদ্দিনের চেয়ে ১০ থেকে ১৫ বছরের ছোট।

এই গানটি সম্পর্কে আমাকে পুরোপুরি অবহিত করেন সাংবাদিক আল-হেলাল। মাহবুব কবির সম্পাদিত ‘উকিল মুন্সির গান’ বইটির রিভিউ পড়ে তিনি আমাকে নিজের সম্পাদিত ‘গানের সম্রাট কামাল উদ্দিন’ বইটির সফট ভার্সান পাঠান। তার সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ হলে তিনি গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য জানান। এর আগে বলে রাখি আল-হেলাল অনেক বছর কামাল উদ্দিনকে নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লিখছেন। তিনি জানান, উকিল মুন্সী ও কামাল উদ্দিনের গানের পাঠ দুটি ভিন্ন। পাঠকদের সুবিধার্থে পাঠ দুটি নিচে দেয়া হলো-

কামাল উদ্দিন

আষাঢ় মাসের ভাসা পানিরে, ও পানি পূবালী বাতাসে
বাদাম দেখে চাইয়া থাকি, আমার নি কেউ আসেরে।।
কল কলাইয়া শব্দ শুনি, নতুন পানির ধ্বনি
শব্দ শুনে অভাগিনীর, কাঁদিছে পরানীরে।।
একা ঘরে বসত করি, কে করবে আদর
ভাইও নাই বান্ধবও নাই মোর, কে লইবে খবর ওরে।।
বৈশাখ গেল জৈষ্ঠ্য আইল, গাছে পাকা আম
আইলায় না মোর প্রাণের বন্ধু, কারে খাওয়াইতামরে।।
আমার এক বৎসর হইল গত, আমার কে নিবে খবর
বাউল কামাল উদ্দিন আশায় থাকি, না নিল নাইওররে ।।

(উৎস : ১৩ মার্চ ২০০৩ বৃহস্পতিবার লাকী ফটো স্টুডিওতে বাউল ভোলানাথ/আল-হেলাল সম্পাদিত ‘গানের সম্রাট কামাল উদ্দিন’)

উকিল মুন্সী

আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে পূবালী বাতাসে_
বাদাম দেইখ্যা চাইয়া থাকি আমার নি কেউ আসে রে।।
যেদিন হতে নয়া পানি আইলো বাড়ির ঘাটে সখী রে
অভাগিনীর মনে কত শত কথা ওঠে রে।।
গাঙে দিয়া যায় রে কত নায়-নাইওরির নৌকা সখী রে
মায়ে-ঝিয়ে বইনে-বইনে হইতেছে যে দেখা রে।।
আমি যে ছিলাম গো সখী বাপের গলায় ফাঁস সখী রে
আমারে যে দিয়া গেল সীতা-বনবাস রে।।
আমারে নিল না নাইওর পানি থাকতে তাজা সখী রে
দিনের পথ আধলে যাইতাম রাস্তা হইত সোজা রে।।
কতজনায় যায় রে নাইওর এই না আষাঢ় মাসে সখী রে
উকিল মুন্সীর হইবে নাইওর কার্তিক মাসের শেষে রে।।

(উৎস : মাহবুব কবির সম্পাদিত ‘উকিল মুন্সির গান’, পৃষ্ঠা ৩৪)

ইন্টারনেটে দেখেছি কোনো কোনো উৎসে উকিল মুন্সীর গানটিতে কিছু কিছু শব্দের হেরফের ঘটেছে।

দুই.

উকিল মুন্সী ও কামাল উদ্দিন দুজনেই ভাটি অঞ্চলের মানুষ। একই ভাবতরঙ্গ ও গীতধারা তাদের স্পর্শ করেছিল। তাদের দেখা প্রকৃতির রূপ বাহ্যত একই। দুজনের জীবনজিজ্ঞাসা হয়তো ঐতিহ্যিক দিক থেকে অনেকটা কাছাকাছি হতেও পারে। অন্তত চিত্রকল্পের মধ্যে আঞ্চলিক ছাপটা স্পষ্ট। ভাবের মোটিফ বা প্রকৃতি থেকে ধার করা চিত্রকল্পের ক্ষেত্রে অনেকটা কাছের মনে হয়। আবদুল ওয়াহিদ জানাচ্ছেন মালজোড়া গানের আসরে তারা অনেকবার পরস্পরের প্রতিপক্ষ ছিলেন। গানের পাঠ দুটি থেকে তাদের তর্ক নিয়ে আগ্রহীরা কল্পনাশক্তিও খাটাতে পারেন। উপরের গান দুটির বিষয় নাইওর। সে নাইওরে মিল-অমিলও আছে। এভাবে হতে পারে তর্ক। কল্পনার বাইরে না গিয়ে এবার আরও কিছু অনুমানের ওপর জোর দেয়া যাক-

কামাল উদ্দিন/কামাল পাশা (১৯০১-১৯৮৫)

কামাল উদ্দিন/কামাল পাশা (১৯০১-১৯৮৫)

উপরে গান দুটি গানের মুখরা বা শুরুর লাইন দুটি ছাড়া আর কোথাও মিল নেই। তাতে যে অমিল- বোঝা যায় দুটি গান আলাদা আলাদা ব্যক্তির লেখা। তাতে একই বিষয় চিন্তার বৈচিত্র্য রূপ ধরা পড়ে। প্রথম লাইন দুটি ছাড়া আরেকটি মিলের জায়গা আছে। যার কারণে মনে হতে পারে দুটো গান একই। যদি কেউ মনোযোগ দিয়ে খেয়াল না করেন। সেটা হলো গানের সুর। যদিও কামালের গানটি আমার শোনা হয়নি। তবে এটা স্বাভাবিক যে, সুর এক না হলে এ দাবিটি করা হচ্ছে না। তাহলে তর্কটা কিসের গানের প্রথম লাইন দুটির নাকি সুরের।

আমরা এবার অন্য দিক থেকে কিছু কথা তুলতে পারি। বাংলা লোকগানের দিক থেকে গান শুধু কোনো কলা-কৌশল চর্চা না। আসলে মানুষের যে কোনো কর্ম প্রচেষ্টার একটা ভেতরকার দিক থাকে। সেটা এক ধরনের ধ্যান বটে। আমরা হয়তো একে বাইরে থেকে একে শুধু গান বলে সার্বিক নামে ডাকব। এ অর্থে নিছক গানই এর মর্মবস্তু না। বরং এর তাৎপর্যময় দিক হলো_ বাংলায় ভাব বলি বা দর্শনই বলি এমন চিন্তার বাহন হয়েছে সঙ্গীত। দর্শনের একাডেমিয়ানা বা লিখিত হয়ে থাকার যে ট্র্যাডিশন_ বাংলায় তা ততটা সরল নয়। আবার ভাবচর্চা মুদ্রণে না কলবে আত্মস্থ হবে তার বিষয়ই তো আছে। ভেবে দেখতে হবে কোন বিষয়গুলো আমাদের আত্মস্থ করতে হয়। এখানে জীবনের নানা প্রশ্ন ও তার উত্তর গানে গানে মেলানোর চেষ্টা হয়েছে। একের গানের ভেতর দিয়ে আসা প্রশ্ন অন্যকে ভিন্নভাবে দেখতে সাহায্য করে বটে। এছাড়া আসরে ওঠা প্রশ্নও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন চিন্তাসূত্রের পাটাতন থেকে আসা। ফলত মিলেমিশে থাকে ভাবের পরম্পরা, ভক্তি, আত্ম অন্বেষণ এবং কর্তাসত্তার বিকাশ ধারার মধ্যে অনেক ভেদ আছে, যা ঐহিক ও পরমার্থিক ভাবকে বুঝতে চেষ্টার ভেদ। সে দিক থেকে এখানে গান শুধু সুর আর কথার মেলবন্ধনের মামলা নয়। অনেকের ক্ষেত্রে করণের দিকটি গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখা দরকার বাংলার ভাবের মধ্যে যেখানে করণের বিষয় এবং দার্শনিকতা বিদ্যমান তার সূত্রগুলোর অনেকখানি এখনও তাজা আছে। সেখানে কোনো গানের লেখককে তা যেমন গুরুত্বপূ্র্ণ, তবে চিন্তার সূত্র হিসেবে গানের বাণীটি মুখ্য। সে দিক থেকে দুটো গানের বাণী নিয়ে আলোচনা হতে পারে। তবে সেদিকে গেলাম না। তবে একটা বিষয়, একের ধারণা অপরজন এভাবেও পরখ করতে পারে। সেখানে কেউ একজন আগে লিখল, কেউবা পরে।

বৈষ্ণব ধারার গান বা কীর্তন ঢঙের গান আমরা প্রায়শ শুনি। গানগুলোর সুরও মোটামুটি একই কিন্তু কথা আলাদা। অথবা একটা প্যাটানকে ভেঙে আমরা অনেক সুর পেয়ে থাকি। তাকে আশ্রয় করা গানের বাণীও আলাদা। সে দিক থেকে বাংলা লোকগানের ক্ষেত্রে একই সুরের পুনরাবৃত্তি খুবই সাধারণ একটি ঘটনা। এই পুনরাবৃত্তি যেমন একই সাধকের ভিন্ন ভিন্ন গানে ধরা পড়ে, তেমনি আবার অনেকের গানে একই সুরের পুনরাবৃত্তি ঘটে। সে রেশ কিন্তু এখনও রয়ে গেছে।

একটু অন্যরকম বিষয় নিয়ে কথা বলি। সাম্প্রতিক মর্ডান ফোকের দিকে আমরা নজর দিতে পারি। আবুল সরকার, মমতাজ, শাহ আলমের গানগুলো শুনুন। দেখবেন একই ধরনের সুর ঘুরে-ফিরে আসছে। আবুল সরকার এক আলাপে বলেন, গানের কথা আলাদা হলেও অনেক ক্ষেত্রে সময়ের অভাবের কারণে একই সুরের ব্যবহার তারা করে থাকেন। এমনকি হিন্দি গানের সুর ভেঙে। কিন্তু তার দাবি সুরে বৈচিত্র্য না থাকুক_ গানের বাণী এবং চিন্তা একদম আনকোরা। আবার কোনো কোনো সুরটি জনপ্রিয় হয়ে উঠলে একই সুরে করা অন্য গানটি সহজে মনোযোগ কাড়ে। আরেকটি বিষয় অনুমান করা যায়, একটা প্যাটানের সুরের সঙ্গে কোনো নির্দিষ্ট বিষয় মিল পাওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রেও সুর অনেকটা সাহায্য করলেও গানের কথাটা গুরুত্বপূর্ণ। এখানকার সময়ে ভোক্তা চাহিদা যতটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আগের কালে বিষয়টা এমন ছিল না। বরং, গানের ভাব প্রবণতা এর গুরুত্ব ভূমিকা পালন করে। এ ধরনের সুরের খেলার সবচেয়ে সুন্দর উদাহরণ আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি গাওয়া হয় কুষ্টিয়ার গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাবো তারে’ গানটির সুরে।

এরপর যে বিষয় থাকে এই ধরনের মুখরা দিয়ে গানের শুরু। উভয়ক্ষেত্রে গানের রচনার সাক্ষী নাই আপাতত আমাদের সামনে। আবার আবদুল ওয়াহিদ বলছেন তিনি বিভিন্ন আসরে কামাল উদ্দিনকে এই গান গাইতে শুনেছেন। অন্যদিকে উকিলের পুত্রবধূ বলছেন গানের কার্তিক মাস শব্দটা তার পীরের মৃত্যুকে নির্দেশ করে। এ অর্থে উকিল বিশেষ ভাবপ্রবণতা ও উপলক্ষকে কেন্দ্র করে গানটি রচনা করেছেন_ এ দাবি মতে। কিন্তু কোনো দাবিই বলে না গানটি প্রথম কে লিখেছেন বা সুর করেছেন। এবং একইসঙ্গে প্রথম লেখার দাবি খুঁজে বের করা কতটা দরকারি সেটাও প্রশ্ন। মনে হয় না তার দরকারও আছে। তবে আরেকটা বিষয় নিয়ে বলা যেতে পারে_ কেন একইরকম গান দুজনকে লিখতে হলো। সেটা মনে হয় খানিকটা এভাবে বলা যায়, যেহেতু গানই ছিল এক ভাবের হয়ে অন্য ভাবের ক্রিটিক। সেদিক থেকে দুটি গান রচিত হওয়ায় স্বাভাবিক। হয়তো এমনই। গানের আর্তি নিয়ে হয়তো তাদের মধ্যে কোনো দ্বিধা ছিল না।

অথবা আগে না পরে লেখার দাবির না করার মধ্যে মহৎ উদারতা থাকতে পারে। অন্তত এ বিষয় নিয়ে আমরা আগের যুগে কোনো হল্লা হয়েছে বলে শুনি না। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিষ্য নিজের গানের ভণিতায় গুরুর নাম জুড়ে দিয়েছেন। এমন উদাহরণ কম না। এসব মালিকানার চেয়ে ভাব বিচারে আমাদের গীতধারা অনেক সমৃদ্ধ। এর মানে এ নয় যে, যিনি লিখেছেন তাকে অস্বীকার করা হচ্ছে। বরং, যুগপৎভাবে অপরাপর লেখকের মূল্য স্বীকার করতে হবে। একইসঙ্গে তার গান যে অন্য কারও নামে তার গান গাওয়া হচ্ছে এমন দাবির সম্ভাবনাকে অস্বীকার করা হচ্ছে না। শুধু তাই নয়, কারও সাধনার ধনকে তার মূল থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার মধ্যে ভালো-মন্দ কোনো আবিষ্কার নাই। বরং, সে প্রেক্ষিত ধরেই অনন্যতর কোনো অনুমানে পেঁৗছতে পারাটা মূল্যবান হতে পারে। তাই লেখকের হদিস না মেলা তো বদনসিবই। তাই স্বীকার-অস্বীকারের বিনয়ের বাইরে আরেকটা রূপ থাকে। আমাদের ভাগ্য ভালো দুটি গানের লেখকের হদিস আমরা জেনেছি এমন দাবির সুযোগ রয়েছে।

এটা ঠিক কামাল উদ্দিনের ক্ষেত্রে নাম নেয়ার ক্ষেত্রে অজস্র কৃপণতা ঘটেছে। আবদুল ওয়াহিদ ও আল-হেলালের মতো গুটিকয় মানুষ তার কীর্তিকে সবার সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। সে চেষ্টাই সাধুবাদ। গানের এ বিষয়ে মাহবুব কবিরের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। আলোচ্য গান সম্পর্কে জানান তার সংগৃহীত গানটি উকিলের। তবে এ পর্যন্ত তিনি সঙ্কলনে গ্রন্থিত ছয়টি গান চিহ্নিত করেছেন যেগুলো উকিল মুন্সীর রচনা নয়, যা পরবর্তী সংস্করণে সংশোধনের আশা রাখেন।

কৃতজ্ঞতা : মাহবুব কবির ও আল-হেলাল।

তথ্য সূত্র
১.http://dailysylhet.com/sunamgonj/৪১৫৯৪.php ইন্টারনেটে প্রকাশকাল ১৮ নভেম্বর, ২০১৩। সভাটি অনুষ্ঠিত হয় ১৭ নভেম্বর, ২০১৩।
২. সাক্ষাৎকারটি নেয়া হয়েছে ১৫ অক্টোবর ২০১৩। উৎস : www.1newsbd.com/ ইন্টারনেটে সাক্ষাৎকারের লিঙ্ক এখন প্রতুল নয়, তাই প্রকাশের তারিখ জানানো গেল না।

………………………………

*লেখাটি আলোকিত বাংলাদেশের বিশেষ আয়োজন শুক্রবার-এ পূর্ব প্রকাশিত।  ‌’বাংলা লোকগানের দিক থেকে গান শুধু কোনো কলা-কৌশল চর্চা না।’- অসাবধানতাবশত এ লাইনের ‌’না’ শব্দটি বাদ পড়ে যায়, এখানে যোগ করে দেওয়া হলো।

উকিল মুন্সীকে নিয়ে আরো ক’টি লেখা-

১.উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে
২.উকিল মুন্সীর গানের ভেতর বাড়ি
৩.মধ্যাহ্নের উকিল মুন্সী
৪.কতকাল বিদেশ রবে উকিল
৫.অনন্ত বিরহে উকিল মুন্সী

Comments

comments