কাছে বলেই দূরে আছি

এই জগতে আসলে নিজের কিছু কি আছে বা থাকে, নাকি নিজ বা আমি- কিছু একটা ধরে নিয়ে অলীক আসা যাওয়া। বাস্তবিক আছে কিনা তর্ক সাপেক্ষ, তবে ধারণা আকারে তো কিছু একটা লালন করি। কি সেই? তারে নিয়ে ঘুরি ফিরি, তাকে নিয়ে খাই দাই, বাচি মরি। শুধু তারে বুঝি না। হয়ত তার কাছে বলেই দূরে আছি।

এক.

দাউদ আর আমি স্বচ্ছ কাঁচের মতো রোদের ভেতর দিয়ে হাঁটছি। আমার গন্তব্য কক্সবাজারের রামু। দাউদ নিচে নেমে এসেছে বিদায় জানাতে, সাথে দিনের প্রথম সিগারেটটা শেষ করতে। রোদ আমার ভালো লাগে। মনের মধ্যে সবকিছু যেন পরিষ্কার হয়ে আসে। বাতাসে কফি আর আইসক্রীমের মিলিত সুবাস। ইনফ্যাক্ট, আন্টি আইসক্রিম আর কফি খাওয়াইছেন। দুটোর সাথে রোদের কেমন যেন ভাব হয়ে গেছে। উইশ ইউ অল দ্য বেস্ট!

বিদায় নিয়ে রিকশায় উঠি। গন্তব্য বহাদ্দার হাট টার্মিনাল। কক্সবাজারের বাস ধরব। নামব রামু বাইপাসে। সেখান থেকে আর্মি ক্যাম্পে। মেজর জাকিরের সাথে  ক্লাস সিক্সে তিনমাস একসাথে পড়েছি। আমাকে প্রথম চিঠি লিখেছিল সাদি (জাকিরের ডাক নাম), ক্লাস সিক্সেই বোধহয়। ডাকপিয়ন যখন আমায় চিঠিটা দিয়ে গিয়েছিল। খামের উপর নিজের নামটা অদ্ভুত লেগেছিল। এই ফিলিংস বোঝার নয়। আমার প্রথম চিঠিটা লিখেছিলাম নানাকে, ক্লাস থ্রি-তে থাকতে। কি লিখেছিলাম মনে নাই। তবে এটা বুঝি এই লেখালেখির ভেতর আর কিছু নাই থাক- নিজেকে জানান দেয়া আছে। আপনার আমিত্বকে জাহির করা। আমি ধ্রুপদী কোন আলাপে যাবো না। শুধু নিজের অনুভূতির কথা বললাম।

বহাদ্দার হাট টার্মিনালে শাহ আমিনের টিকেট কাটলাম। ইদানিংকার নতুন রোগ ভুল বাসে ছড়ে কিছুদূর চলেও এসেছিলাম। পরে অনেকটা হেটে শেষ মুহুর্তে সঠিক বাসে উঠি। এটা নিয়ে কি হলো- নিজের একটা বৈশিষ্ট্য দেয়া গেল বটে। কিন্তু আমি আর এই ভুল করা দুটো সদর্থক নয়। এখানে আমি কই!

কক্সবাজারের পথে আলাদা সৌন্দর্য আছে। চকরিয়া থেকে কেমন যেন জঙ্গলের মধ্যে চলছি ধরণের ভাব। চাঁদনী রাতে এটা নিশ্চয় বেশ উপভোগ্য। কিন্তু আসার পথে মিস করেছি। কোন কারণ নাই। বাসের পর্দা সরাতে ইচ্ছে করে নাই। অবস্থার মাঝে নিজেকে সমর্পনে আমার ক্লান্তি নাই। দ্বিতীয়ত: বেশ ক্লান্ত ছিলাম বলে ঘুমিয়ে পড়েছি। মাঝে মাঝে কল্পনা করি এই সংরক্ষিত বন ধরে অনেক দূর হেটে যাবো। এই মনোবাসনা জেনে সাদী বলেছিল- নামেই সংরক্ষিত বন। ভিতরে সব ফকফকা। আমিও দেখেছি বেশির ভাগ জঙ্গলেই আসল গাছ কেটে ইউক্যালিস্টাসের মত বিজাতীয় ও ক্ষতিকারক গাছ লাগানো হয়েছে। এইসব ভেবে নিজের রোমান্টিক ভাবটা চাঙ্গা রাখা আরকি!

যেটুকুই আছে সে জঙ্গলের রূপ দেখেই মন ভালো হয়ে গেল। অবশ্যই ভ্রমনে আমার মন সবসময় ভালোই থাকে। দুপুর দেড়টায় রামু বাইপাসে নামলাম। নামতে না নামতেই গাড়ি পেয়ে গেলাম। মিনিট বিশেক সাদীর সাথে কোলাকুলি।মোটামুটি ছয় বছর দুই হপ্তা পর।

এইখানকার আর্মি ক্যাম্পের একটা অংশ পড়েছে কৃষি সম্প্রারণ বিভাগের বাউন্ডারির ভেতর। জায়গাটাকে সবাই নারকেল বাগান নামেই চিনে। কক্সবাজারে নতুন কয়েকজনের সাথে পরিচয় পর নারিকেল বাগানের কথা বলতেই তারা চিনে গেছে। আসলেই জায়গা সুন্দর। আসার পথে গাড়িতে বসে রামুর যতদূর চোখ গেছে খুবই ভালো লাগছিল। বেশ দূরে পাহাড়। সামনে খোলা জমিন। মনে হচ্ছিল এমন কোথাও আমি থাকতে চাই। পাহাড় কেন এত ভালো লাগে জানি না।

হয়ত নির্জনতার কাছে আছে নিঃসঙ্কোচ প্রকাশ। ঐ যে নিজের কাছে ফেরা। কিন্তু সব কিছু হারাবার ভয়ে মানে নিজের বলে কিছু নাই দেখার ভয়ে হয়ত নির্জনতাকে বেশিক্ষণ সহ্য করা যায় না।

দুই.

নারিকেল বাগান বলে কথা, পর পর দুই গ্লাস ডাবের পানি খেলাম। বেশ তেষ্টা পেয়েছিল বটে। কিছুক্ষণ পর হেটে এলাম সে বাগানে। ঢেউ খেলানো পাহাড়ি উচুঁ নিচু পথ। শেষ বিকেলের মরে আসা আলো। দুই একটা পাখি ডাকছিল। সহনীয় গরম। আমি আসলে স্তদ্ধ। দুই বন্ধু মিলে এই সেই কি যেন বলছিলাম, কিন্তু আসলে মন পড়ে আছে ভয়ানক নির্জনতার ভেতর। ইচ্ছে হলো আরো আরো অনেকটা সময় চুপচাপ কাটাই। বৃথা জীবনের উদ্দেশ্য-বিধেয় আর সময় কাটানো নিয়ে ভাবনা কেন!

এই নিজ বা আমি কতটা হতবুদ্ধিকর বিষয় তার জন্য পুরানা একটা লেখার সাহায্য নিই-

আমি যখন বলছি আমি– তখন কাকে বলছি? কিছু না কিছুকে অথ্যার্ৎ নির্দেশনা আকারে চিহিৃত করতে যাচ্ছি। আমি আমার দেহের দিকে আঙ্গুল তাক করে অথবা আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে নির্দেশ করে বলতে পারি আমি। অর্থ্যাৎ আমিকে নির্দেশনামূলক অর্থে পাওয়া যায়। আবার যদি বলা হয়, সকল নামবাচক শব্দ কিছু না কিছুকে নির্দেশ করে। সে হিসেবে আমিরও নির্দেশনামূলকভাবে ব্যাখ্যাত হবার হক্ব রাখে। এবং এভাবে হয়তো বা অন্য আমির সাথে পার্থক্য নির্দেশ করা সহজ। আর এই অন্য আমি সহজে তুমিরূপে আবির্ভূত হই। যা আমার কাছে আমি, অন্যের কাছে তা তুমি। এভাবে আমির নির্দেশনা অন্য আমির সাথে সাধারণ পার্থক্য নির্দেশ করে। এই আমি কে যদি দৈহিক নির্দেশনায় বিভাজিত করি, তবে আকারগত সাযুজ্যতা এই পার্থক্যকে মৃদৃ অর্থে নির্দেশ করে। তখন কি বলা যায় এই আমি অসংখ্য তুমির মতো। অবশ্যই না। কারণ নিদের্শনাই সেই পার্থক্যকে দেখিয়ে দেবে যা শুধু বাহ্যিক আকারে নয়, তার সাথে অর্থের নিজস্ব বুঝাপড়া আছে। সে মোতাবেক দুটি আমি কখনো এক হয় না।

এই বিভেদের কারণে মানুষে মানুষে পরিচয়ে মানুষের ভাগাভাগি- মাঝে মাঝে হয়ত ভাবি। ভালো লাগে, তবে কূল পাই না। হতে পারে এর জন্য জীবন এত আনন্দের।

এমন আত্মহারা হয়ে ঘুরছি। আমার জন্য আরো সারপ্রাইজ বাকি ছিল। রাত্রিতে এই নারিকেল বাগান কেমন দেখায়।

তিন.

আমার বন্ধুর স্ত্রীর রান্না দারুন। রেসিপিগুলোও অন্য রকম। শাহাদাত উদরাজি ভাইকে মনে পড়ছিল। ইচ্ছে করছিল তাকে দিয়ে খাবারগুলো টেস্ট করাই।

খাওয়ার পর নিরস একটা সময় কাটে। কারণ আমার ঘুম আসে না। কিছুক্ষণ ফেসবুক ঘাটাঘাটি। দুটো লেখা এডিটের চেষ্টা করলাম। চেষ্টা বিফল। কিছুতেই মন বসে না। ইচ্ছে করছিল অনেক দূর কোথাও চলে যাই। কোথায় তা জানতে না পেরে পরের দিন কক্সবাজারে কি করব তার প্লান করি।

সন্ধ্যায় নাস্তা খেয়ে আবার বের হওয়া। গাড়ির আলোতে আঁকা বাঁকা নারিকেল বাগানের সরু রাস্তাটিকে খুব সুন্দর দেখায়। প্রথমে বসে রইলাম একটা টিলার উপরে। বাঁশ দিয়ে বানানো বেঞ্চিতে। আকাশে বাঁকা চাঁদ। মেঘের মাঝে লুকোচুরি খেলছে। তার আলো সামনের অন্ধকারকে আরো রহস্যময় করে তুলেছে। দুই টিলার মাঝের খাদের গভীরতা বুঝা যাচ্ছে না। তবে আলো-আধারি তার গভীরতাকে বিভ্রমে ঠেলে দিয়েছে। আমাদের উল্টো দিকে টিলাতে একটা গাছ একা দাড়িয়ে আছে। আমার কিছু বলার ছিল না। তাই শুনছিলাম। আবার চেষ্টা করি নিজের কথা বলার। কিন্তু কোন কথায় আসে না মুখে। প্রকৃতির মতো মুক হয়ে গেছি যেন। নিজেকে মহিমান্বিত করার কিছু পাই না। তখন ভাবি আমিই এই বৃক্ষ। যে চন্দ্র-সূর্যের শোভা হয়ে থাকে। রাতের আকাশে ফুটে উঠে তারার মতো। তাকে গল্প শুনায় লক্ষ লক্ষ ঝিঁঝিঁ পোকা। ভাবতে খুবই ভালো লাগছিল।

বন্ধুর কথায় আঁধারের গানে ছেদ পড়ল। এখন ম্যালেরিয়ার সিজন। উঠা যাক। আসলে উঠেছি কই। এটা আমাদের যাত্রার মধ্যভাগ।

এরপর আমরা হারিয়ে যায় পাহাড়ের আরো গভীরে। রাতের বেলা আর নতুন বলেই গভীর বলছি। কারণ পুরো এলাকাটাই গাছ গাছালি কেটে নারিকেল গাছ লাগানো।মেটো রাস্তাও আছে। রীতিমত জিপ চলছে। এই বাস্তবতাকে ধরে নিয়ে বসে থাকলে চলে কেন? আরো অনেক উচুঁ একটা টিলার উপর আমরা থামি। লাইট নিভিয়ে চুপচাপ বসে থাকা। অন্ধকারের গান শুনা। দৈহিক জীবনের ভাবনায় কোন কূল পাই না। এক ধরণের ক্ষুদ্রতা গ্রাস করে। এরচেয়ে অনন্ত, অসীম, নিখিল কিছু ডাকে। তার ডাকে সাড়া দিতে গেলে দেহ ছেড়ে আরো বহুদূরের পথ, হয়ত খুব কাছে। ভিন চিন্তায় আছি বলে দূরে। হয়ত কিছুই তুচ্ছ নয়- এই দেহ, এই আত্মা- সবই ইশারা মাত্র। সেই ইশারা ধরে আমরা পাড়ি দিই অনন্তের পথ।

থাক সেই সব কথা। শুধু বলি, সে দিনটা ভুলার নয়। তার বর্ণনা আমি দিতে পারব না। অথবা আর কিছু বলার চেষ্টা করলে সেই অনুভূতিটা হারিয়ে যেতে পারে। এই ক্ষুদ্র জীবনে কি এমন দিন ফিরে ফিরে আসে!

মনে শুধু বলছিল, নিজ বলে যার কাছে আমি ফিরতে চাই- তার পথ এখনো আমি খুজে পাই নি। আমি অন্ধকার আর নির্জনতাকে ভালোবাসি এ কারণে তারা এই কথাগুলো মনে করিয়ে দেয়।

Comments

comments

5 thoughts on “কাছে বলেই দূরে আছি

  1. এতো সহজভাবে কিভাবে লেখা যায় তা বুঝতে পারি না। কেমনে হয় সাধারণ যাত্রার অসাধারণ শব্দযাত্রা। হিংসা করতে ইচ্ছে হয়। সেটাও পারি না।

  2. কবে কক্সবাজার গেলেন আর কবে ফিরলেন। আপনাদের এই বয়সটা যদি আবার ফিরে পেতাম। ঘুরাঘুরি আমার পছন্দের একটা বিষয়। বিবাহ না করলে হয়ত সারা জীবন ঘুরেই কাটাতাম। তা আর পারলাম কই!

    (রান্না দেখলেই আমার কথা মনে পড়ে এটা শুনে খুব আনন্দিত হলাম। হা হা হা… আমার রেসিপি বা রান্না গুলো আপনারা অনেকেই পছন্দ করেন জেনে আরো সাহস পাই।)

    • আপনে দেখছি বেশ খারাপ মানুষ। এখানে বিয়ে নিয়া যা বললেন, আপনার রেসিপির কমেন্টে তো তার উল্টোটায় বলছিলেন। তখন বিয়ের দাওয়াতই চাইয়া বসলেন।

      হা হা হা 😛

Comments are closed.