শরিয়তপুরে দেখার কিছু নাই

মানসিংহের দুর্গ

মানসিংহের দুর্গ

আগে বলেছিলাম, বন্ধুরা আশ্বস্ত করেছে শরিয়তপুরে দেখার মতো কিছু নাই। তারা তো কাজ-কর্মের পর আড্ডা দিয়েই বেড়ায়, কোন কিছুর দেখার ধার ধারে না জানি। ব্যাপারটা হলো তারা আসলে অন্য অনেক কিছুর চেয়ে সম্পর্ক মেইনটেইনে ব্যস্ত। ঘোরাঘুরি মানে হোন্ডা নিয়ে শহরের এমাথা ওমাথা। এই অঞ্চলের একটা বৈশিষ্ট্য হলো মোটামুটি সব তরুণের হোন্ডা আছে। সেটা এখন বাংলাদেশের গ্রাম অঞ্চলের সাধারণ প্রবণতা হয়ে দাড়াচ্ছে। সে যাই হোক নিজেকে তাদের হাতে ছেড়ে দিলাম।

আসার আগে বলেছিলাম, এক মুহুর্তও স্থির থাকব না। কিন্তু গরম দারুনভাবে কাবু করে ফেলল। দুপুরে খাবারের পর লম্বা ঘুমও দিয়ে ফেললাম। আর কি বলল! আমার বন্ধুর বউ রাঁধেও দারুন। বিকেলে সবাই একত্রিত হলাম। মানুষ সাত জন, হোন্ডা তিনটে। গন্তব্যের অপশন দুটো। সুরেশ্বর দরবার শরীফ অথবা মেঘনা ঘাট। বিষয়টা খুব মজার। এখান থেকে ঢাকা ৭৪ কি.মি. (সুযোগ পেলেই বলে ব্রীজ হলে যেতে মাত্র দুই ঘন্টা লাগবে!) আর চাঁদপুর তো মেঘনা নদীর ওপাড়ে। মাত্র ৩৭ কি.মি.। আমি এসেছি পদ্মা ধরে। যদি নোয়াখালী ফিরতে চাই যেতে পারি মেঘনা ধরে।পদ্মা কোথায় মেঘনায় এসে মিশেছে? চাঁদপুরে। মনে হচ্ছিল সামান্যের জন্য মোহনা দেখা মিস করলাম। কি করলাম আল্লায় জানে! যে দুটো গন্তব্য নিয়ে বাদ-বিবাদ হচ্ছিল এরা দেখি এর কোনটায় যাবে না। কথা দিল ফেরার পথে নদীর পার ধরে আসবে! কোথাকার কি! এমন কি নদীর জলে চাঁদও দেখা হলো না।তবে নৈসর্গের মাঝে চাঁদ তো ছিল।

প্রায় ঘন্টাখানেক ঘুরাঘুরি পর আঁকা বাঁকা রাস্তা পার করে নিয়ে আসল দুটো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেখাতে। জেড এইচ সিকদার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং জেড এইচ সিকদার মেডিক্যাল কলেজ। আমার বন্ধুরা এই দুটো নিয়ে খুবই গর্বিত। স্থপনাগুলো সুন্দর। সন্ধ্যা হলে আমরা মেডিক্যাল কলেজের চমৎকার স্থাপত্য শৈলীর মসজিদে নামাজ পড়ে নিলাম।

ধনুকার মনসাবাড়ি

ধানুকার মনসাবাড়ি

সন্ধ্যায় মিটিমিটি প্রদীপের আলোয় ভেদের গঞ্জ বাজারে পুরি, পেয়াজু আর চা খেলাম। এরপর অনেকটা পথ ঘুরিয়ে পঙ্কজ নিয়ে আসলেন শ্রী শ্রী সত্য নারায়নের মন্দিরে। লাগোয়া অনেকগুলো মন্দির। তিনি প্রত্যেকটাতে ভক্তি ভরে হাত মাথা নুইয়ে হাত দিয়ে স্পর্শ করলেন। কোনটার সামনে মাটিতে মাথা ঠেকালেন। দৃশ্যটা দেখতে দারুণ লাগল। ভক্তি সবসময় দেখতে সুন্দর।জেলা তথ্য বাতায়ন বলছে এটি রামসাধুর আশ্রম। তারপর গেলাম পঙ্কজের দিদি-র বাড়ি। তিনি সবাইকে অপ্যায়ন করালেন।

আবার দীর্ঘপথ পার হয়ে বাড়ি ফেরা। তবে এইবার রাস্তা হারিয়ে ফেললাম। কোন হোন্ডা কোনদিকে গেল ঠিক ন্ইা। মনে হচ্ছিল চরকির মতো একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছি। তীব্র বাতাসে বালু কণা মুখে ঘাই মারছে। দূরে কোথাও হয়তো বৃষ্টি হচ্ছে। বাতাস বেশ ঠাণ্ডা।

যাক, শেষপযর্ন্ত পথ খুঁজে পেলাম। শহরে ফিরে মোবাইলে জেলা তথ্য বাতায়ন খুলি। এই কারবারের জন্য ডিজিটাল সরকারকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। দেখাই, দেখো কত পুরানা ঘর-বাড়ি আছে। তোমরা কিছুই জানো না। আমি উল্টো তোপের শিকার। আগে বলি নাই কেন? না বলে ভালো করেছি। কেননা, আমাদের সময়ে আমরা প্রগতি নামে শিক্ষাদীক্ষাকে কিভাবে ভালোবাসি তার প্রমান তো আবারও পাওয়া গেল। আমি হলেও হয়ত তাই করতাম। বাংলাদেশের আরও কয়েক জায়গায় দেখেছি জেলা তথ্য বাতায়ন যেগুলো ঐতিহ্য ও দর্শনীয় স্থান বলে সেগুলোর সাথে সাধারণ মানুষের পরিচয় বিশিষ্ট অর্থে নয়।

ঠিক হলো পরের দিন কটা স্থান ঘুরে দেখব-

শিবলিঙ্গ

শিবলিঙ্গ

মানসিংহের দুর্গ: লোকে বলে ঈশা খাঁ, বারো ভুঁইয়াদের এই একজনের নামে জায়গাটা চেনে। অবস্থান নড়িয়া উপজেলায় ফতেজংগপুর। ঐতিহাসিক মানসিংহের দুর্গের ভগ্নাবশেষ বলতে তিনটি দালানের অংশবিশেষ আছে। সেগুলো আবার একটা বাড়ির মধ্যে পড়েছে। বড় দালানটা দেখার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু মানুষের বাড়ির মধ্যে ঢুকতে কেমন যেন লাগে। তারা যদি বিরক্ত হন। এরা দালানগুলোকে বানিয়েছে লাকড়ি রাখার স্থান। সুযোগের সদ্ব্যবহার না স্থানের সদ্ব্যবহার বুঝলাম না। এখানেও ইতিহাস জানব কার কাছে বুঝে পেলাম না। যাওয়ার রাস্তা এত বাজে! কাঁচা রাস্তা শেষে পুকুর পাড় ধরে যেতে হয়। মানসিংহের আমলের রাস্তা কই গেল কে জানে?

শিবলিঙ্গ: উপমহাদেশের শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার ভোজেশ্বর ইউনিয়নে কষ্ঠিপাথরের সর্ববৃহৎ শিবলিঙ্গটি পাওয়া গেছে।শিব অনার্য দেবতা। সুতরাং, লাইফ ওকে চ্যানেলের মতো গোরা হবার কথা না। কালো শিবের কালো লিঙ্গ, ঠিকই আছে। শিবলিঙ্গ নিয়ে প্রচলিত একটা কথা, এটা নাকি কেউ বানায় না। বানানো অবস্থায় মাটির নিচে পাওয়া যায়। ব্যাপারটা এমন হলে তো দারুন। উই লাভ মিরাকল।

ধানুকার মনসা বাড়ি: জেলা তথ্যবাতায়ন বলছে, চন্দ্রমনি ন্যায়, ভুবন হরচন্দ্র চুড়ামনি ও মহোপাধ্যায়, শ্রীযুক্ত বামাচরণ ন্যায় প্রভৃতির জন্মস্থান ধানুকায়। এখানকার শ্যামমূর্তি জাগ্রত দেবতা বলে কিংবদন্তী রয়েছে। কিন্তু এরা কে এই বিষয়ে কিছু বলা নাই। শুধু তা না, এটা বলার জন্য কেউ সেখানে থাকবে তাও আশা বৃথা। তবে একজনকে দেখা গেল দুই তরুন-তরুনীর ভাগ্যলিপি পড়ছেন। ভাগ্য এভাবে জেনে যাওয়ার মতো দুর্ভাগ্যের কি হতে পারে। সুখী জীবনের একটা টিপস দিতে পারি- ভবিষ্যত জানতে চাইয়েন না। তার মানে এই না যে, ভবিষ্যত নিয়ে ভাববেন না।

ধানুকার মনসা বাড়িতে চারটি পুরানো মন্দির দেখলাম। এগুলোর যতœআত্তির বালাই নাই অথবা সর্মথ্য নাই। হয়ত, একটা নতুন মন্দির দিয়ে দিব্যি কাজ চালিয়ে নেয়া যায়। এখানে মেলা বসে। পুরাতন মন্দিরগুলো চমচিকার ডিপো। দিনের বেলায় চামচিকা ডাকছিল আর কেমন যেন খাটাশ খাটাশ গন্ধ। তথ্য বাতায়নে উল্লেখ করেই যেন কাজ খালাস। কি কে কেন-র কোন উত্তর নাই।

Photo1864

রুদ্রকর মঠ:  তথ্য বাতায়ন জানাচ্ছে, দেড়শত বছরের পুরনো এই মঠটি শরীয়তপুর সদর উপজেলার রুদ্রকর ইউনিয়নে অবস্থিত। এই মঠটি দেখার জন্য বহু লোক আসে। আমরা গেলাম। এখানে মেলাও নাকি বসে। ভর সন্ধ্যায় গেছিলাম। একটু ভয় ভয় লাগতেছিল। পুরানা মন্দির নিয়া আমার একটা ভয়ের ঘটনা আছে। মঠের সামনে পুকুর ঘাটলায় কিছুক্ষণ বসে রইলাম। এটাও লাকড়ি রাখার কাজে ব্যবহার হয়।

বুড়ির হাটের মসজিদ: তথ্য বাতায়ন জানাচ্ছে, জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার বুড়ির হাট মসজিদটি খুবই বিখ্যাত এবং ইসলামী স্থাপত্যকলার নিদর্শন। ১৯০৭ সালে নির্মিত এই মসজিদ চত্বরে যখন পৌছলাম মাগরিব নামাজ শুরু হয়ে গেছে। আবার দ্রুত নামাজে যোগ দিলাম। পুরানা মসজিদে নামাজ পড়তে হয় ধীরে সুস্থ্যে। এটা আমার তরিকা। যেন মহাকালকে স্পর্শ করা যায়। কিন্তু এই সময়ে সে সুযোগ পাওয়া কঠিন। ভেতরে ঘুরে দেখলাম। চিনামাটিতে লতা পাতার কারুকাজ। মসজিদের স্থাপত্য আসলে চমৎকার।

হারুঘোষের মিষ্টি: আগের দিন চট্টগ্রামের জোবায়ের মাহমুদ (শরিয়তপুরে আদিবাড়ি) জানিয়েছিল হারু ঘোষের রসগোল্লা আর মাখন খেতে। আরো বলে ছিল মাদারীপুর যাওয়ার রাস্তাটা নাকি খুব সুন্দর। আল্লাহ মানুষকে এতো আজিব করে বানিয়েছেন তারা রাস্তার প্রেমেও পড়ে। প্রেম তো খারাপ না! পড়ুক। হারু ঘোষের দোকানের রস গোল্লা খাওয়া হলো। গরম গরম। ওয়াও! সেই রকম। মাখন খাওয়া হয় নাই। পেটে একদম জায়গা ছিল না। এর আগেও ভেদের গঞ্জ বাজারে অনেক মিষ্টি খাইছি। আসলে মিষ্টি খাইতে হলে ঢাকার বাইরে যেতে হবে। তারা যেমন কোমল ও সুস্বাদু করে বানায়। আবারও ওয়াও।

আর কি দেখলাম? পোষ্ট অফিস, সদর হাসপাতাল, আদালত এইসব। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো হাসি-খুশি কয়েকজন মানুষ আমার মতো রাম গরুড় ছানাকে কত দারুনভাবে গ্রহন করেছে। বাকি সব কিছু থেকে এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। শেষ সময়ে শফিকের সাথে যখন কোলাকুলি করছিলাম খুবই খারাপ লাগছিল। ভালোবাসা এমনই হয়। এরচেয়ে বড় কি আছে দেখার।

হুফ! এইসব ভ্রমন লেখা কি যে বিরক্তকর কাজ। আজ বিদায়। সবাই ভালো থাকুন।

Comments

comments

6 thoughts on “শরিয়তপুরে দেখার কিছু নাই

  1. দেখার কিছু না থাকলেও দেখা যায়…

  2. চশমার ফাঁক দিয়ে দেখে নেয় দৃশ্যের ভিতরের দৃশ্য। সুজন নাকি এমনি। কথা কম দেখি বেশি। না কথা কম লেখা বেশি।

Comments are closed.