হিংস্র, অহিংস, সহিংস

এই শব্দগুলো এন্তার শুনে আসছি। আলাদা আলাদা মানে আছে-  আবার এরা একই ঝাড়ের বাঁশও বটে। হিংস্র শব্দটা ধরে এদিক ওদিক আসা যাওয়া।

হিংস্র শব্দটা আপনার মনে কি ধরনের ভাব নিয়ে আসে? চোখ বুজে কল্পনা করার চেষ্টা করি। দেখছি একটা বাঘ শিকার ধরছে। এই কল্পনা আমাকে কিছুটা ধন্ধে ফেলে দেয়। শব্দটা নঞর্থক। যদি বাঘ শিকার না করে সে কি খাবে! টিকে থাকবে কেমনে! এটাই তো প্রকৃতির মাঝে তার বেঁচে থাকার নিয়ম। ঘাস খাওয়া বাঘ আমি কল্পনা করতে পারি না। বরং একে শুধু প্রকৃতির বরখেলাপই নয়, অরুচিকর মনে হয়। বাঘের এই হিংস্রতা সাধারণত একপক্ষীয় বিষয়।

Untitled-1

তাহলে বাঘের স্বাভাবিক আচরণকে নঞর্থকভাবে দেখানোতে আমার কি যুক্তি থাকতে পারে! একটা যুক্তি হতে পারে- বাঘের বিষয়টাকে সামগ্রিকভাবে বিবেচনা আমরা করি না। অন্য কারণ হতে পারে- এই আচরণ আমরা মানুষের জগতে প্রত্যাশা করি না। তাই এই ধরণের আচরণকে আমরা মানুষের ক্ষেত্রে নঞর্থকভাবে দেখি, যা আসলে ঐ পশুর জগতে স্বাভাবিক রীতি। কিন্তু এই দুনিয়ায় মানুষের উন্নতি-অবনতির সাথে কি হিংস্রতার কোন ধরণের জোর নাই! যে সভ্যতা আমাদের গরিয়ান আর মহান করে তুলছে তা কি হিংস্রতার উপরে গড়া না। নাকি, হিংস্রকে অহিংস করার মহান ব্রত আমাদের সব কালিমা মুছে দেয়। বিলকুল দেয় না।

অপ্রত্যাশিত হিংস্রতার বিপরীতে  ঝাড় থেকে আরেকটা বাঁশ কেটে নিই। তার নাম অহিংস। বেশ মধুর লাগে। এর লগে যদি সর্বজনের মোলাকাত ঘটে তবে চারদিকে ফকফকা ভাব চলে আসে। চোখ বুজলাম। কি আসে পর্দায়? ধরেন বৃষ্টি হইছে- কি সুন্দর নাদুস নুদুস ঘাস জম্মাইলো। দুনিয়ার তাবৎ মানুষ হাসি আনন্দে ঘাসে গড়াগড়ি দিতেছে। ইহা অতি কল্পনা হতে পারে। কল্পনার বাইরে এসে দাঁড়াই।

সাধারণত যারা অহিংস তাদের সাধারণ প্রবণতা কি? এর অনেক অর্থ হতে পারে। কেউ প্রাণীহত্যাকে অহিংসার বরখেলাফ মনে করেন। তাই  অনেকে প্রাণীর মাংস খান না। আবার ধরেন হাতে একখান প্ল্যাকার্ড নিয়া কোন রাস্তার মোড়ে দাড়াইলেন। আপনার দাবি দাওয়া লেখা আছে। দাবি অর্জনে কোন জোর জবরদস্তি নাই।  অভিজ্ঞতা বলে জবরদস্তি না থাকার মূলে সবসময় অসহায়তা কাজ করে- এমন না।

ধরেন আরো অহিংস হইলেন। অন্যরে মারতে না পারার ঝাল নিজের শরীরের উপ্রে ঝাড়লেন। এমন কিছু ব্যারাম আমাদের আছে। কেমন? অনশন করলেন। এটার আরেকখান নাম আছে সত্যাগ্রহ। কিন্তু নিজের শরীর বলে যারে আপনি এই কষ্টটা দিতেছেন- এই নিজের বলার মধ্যে একটা আগ্রাসীভাব তো আছে। আত্মপীড়ন ধর্মীয় জিনিসও বটে। এই ভাবই আপনার শরীরের উপর এটা চাপাইয়া দেয়ার যুক্তি দিছে। এই যুক্তির রুপ হতে পারে- আপনি চিন্তা করেন যে এই শরীর চিন্তা থেকে আলাদা। চিন্তা শুদ্ধ জিনিস আর শরীরে পাপের বাসা। নানান বদ আশা পূরণের হাতিয়ার বা বদ পথে যেতে আপনাকে বাধ্য করে।  শরীর ও মনের ভাগাভাগিতে আপনি অশুচি একটা শরীর নিয়া আছেন বলে তার পাপবোধ। এখানে আপনি আমদানি করেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। প্রতিকীভাবে নিজের দেহরে কষ্ট দিয়া বুঝতে চান এই কষ্ট অন্যে পাক। দেহ শুদ্ধ হয় কিনা জানি না, মন তো শুদ্ধ হয় না।

আপনি অনুভূতিপ্রবণ মানুষ বলেই এমন করেন। সত্যম শিবম সুন্দরমের জন্য এইসব সহ্য করে নেন। লোকে একে মহিমান্বিত করে। এইসব গুরুত্বপূর্ণ মানবিক বিষয় আশয়ে শরীর ক্রিয়া করে। অবশ্যই যাকে আমরা সংবেদনা বলি তা শরীরের বাইরের ক্রিয়া করে না। সুতরাং, বিষয়টা হাওয়াই না। শরীরের একটা ওজন আছে। তাইলে আমরা শরীরের দিকে আগাইতে পারি। শরীর একখান আজব কল। সে নাকি যাহা দেয় তাহা সয়। কে দেয় আর কে সয়? সে কথা আমি কেমনে বলি। সাঁই-ই ভালো জানেন। তারে যে কই পাই! তিনি নাকি দেহেই থাকেন। সে দেহখান কি আমার সম্পন্ন হইছে!

এই দেহের একখান যান্ত্রিক বর্ণনা দেয়া যায়। এবং স্বভাবত একে জ্যান্তবরূপেও দেখা হয়। যেহেতু পঞ্চরিপুর বসবাসও এই ঘরে।সেই ঘরের মধ্যে মন বলে একটা জিনিস আছে। তার একটা আরাম হলো সে যুক্তি দেয়। শুনা যায়, এই শুদ্ধ জিনিসের উপর ফরাসি বিপ্লবের পর থেকে দুনিয়া দাড়িয়ে আছে। সেই যুক্তিশীলতা দিয়ে আপনে দুনিয়া জয় করতে পারেন। এখন চিন্তার করারে দুনিয়ার অন্যান্য জিনিস থেকে আলাদা ভাবতে হবে। এমন কি শরীর থেকেও। কারণ যেটা আপনার চিন্তার বিষয় তা আবার কোনভাবে শরীরি প্রতিক্রিয়ার বিষয় হতে পারে না। জবানের সাথে জবান। জবানের সাখে হাত না। তোমারে যুক্তি দিতে হবে। কিন্তু কোন যুক্তি। কেন আমাকে আপনার মুখের জবাবে মুখে দিতে হবে। আমার কাছে তো কোন ভাগাভাগি নাই। কথা হইল আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে অহিংসরা শুধু জবান দিয়েই ঠেকাতে চান না। তার উপর রিমান্ডও চালাতে চান। তাদের অহিংস এই আশা পূরণ হইছে।

আপনার চিন্তার প্রকাশ যাকে দিয়ে ঘটে, তারে বলেন মসি। অহিংস অস্ত্র। আবার বলতেছেন অসির চেয়ে মসি বড়। ঠিক। চাইলে আপনি হাজারটা মানুষকে মেরে কেটে সাফ করতে পারবেন না। কিন্তু আপনার মসি চাইলে জঘন্য সব লেখালেখি করে হাজার-লাখ-কোটি মানুষের হাতের মুঠি শক্ত করে দিতে পারে। তখন আপনি বলবেন আমি অহিংস কাজ করছি, মোহাম্মদ (সা.)- এর নামে কুৎসা (কুৎসা নাকি যুক্তিবাদী জিনিস) রটাইছি। আপনি ক্ষেপেন ক্যান? আমি তো আপনের শরীরে হাত দেই নাই? তাইলে বুঝা যায় আপনি শরীর আর মনের তরিকা ধরতে পারেন না। নতুবা বিকলাঙ্গ বলে কোনটার কারবার ধরতে পারেন না অথবা আপনার উন্নত দর্শন এত বিকৃত যে, সে সামগ্রিকভাবে মানুষ বুঝতে ব্যর্থ।

ধরেন একদল লোক দিনের পর দিন একই কায়দায় মানুষ মারতে চাইল। সে কিছুই করল না, স্রেফ জবাই করতে চাইল। শুধু চায় তা না, সে মনে করে তার ইচ্ছার একটা নায্যতা আছে। কারণ এর আগের দাবিকে সে দুনিয়ার সবচেয়ে নায্য দাবি মনে করে। যখন সে ইচ্ছার সার্বজনীনতা নামে কিছু হাজির করে, তা কি নায্য হয়! সেটা যাই হোক চিন্তা হোক আর স্রেফ শব্দ হোক, তা কিছু না কিছু তৈরি করে। তার ভেতর যদি ঘৃণা থাকে তবে ভালো কিছু যে আসবে না নিশ্চিত।

সে হয়তো তা মুখে বলে না। বিষয়টা অন্যভাবে দেখা যাক। মানুষ কি চায় সেটা তার ভাষার ধরা পড়ে। চাওয়ার মধ্যে যে খারাপী থাকে সে ভাষার মোড়কে লুকাতে চায়। ইনিয়ে বিনিয়ে বলে। এই চাওয়া অদরকারী না। কিন্তু শরীরি জোস বা জিংঘাসা সে সরাসরি প্রকাশ করছে না, তা সামাজিক নানা ঘটনায় ঠিকই প্রকাশিত হয়। ফলত: হিংস্র না হবার বাসনা যদি শুধু কথার মোড়কই হয় তার হিংস্ররূপটি সমাজ দেহ কোন না কোনভাবে দেখিয়ে দেয়। এই যে, আপনি অহিংস হয়ে সরাসরি অন্যের রক্ত-মাংস খাবার যে আশা পূরণ করেন, তা কিন্তু পূরণ হয় না এমন না। আপনি যখন দল ভারী এবং ফাসিবাদী কায়দায় সে গ্রাউন্ড তৈরি করে রাখেন তবে রক্ত-মাংস খাবার স্বাদ পূরণ হবে। আগুন জ্বালাইয়া রাখলে প্রত্যঙ্গ ঝাপ দিতে আসে। আবার কিছু প্রত্যঙ্গ এটা নাও করতে পারে। সে অহিংসের আগুনে ঝাপ না দিয়া বিপরীত কিছু করে ঝাপ দিতে পারে।

আসলে অহিংস বলার মধ্যে কোন অহিংসভাব বিরাজ নাই। বিরাজ আছে নিজেরে আড়াল করার বাসনা। নিজের নায্যতাকে গরহাজির করে তোলার একটা ভাব।

অহিংসতার মূর্ত প্রতীক গান্ধীজী। তফসিলী সম্প্রদায়কে পৃথক নির্বাচনের সুযোগ দিয়েছিল ব্রিটিশরাজ। গান্ধীজী তা মানতে পারেন নাই। ভোটের রাজনীতিতে বড় ঠকা হয়ে যায়। তিনি অনশনে বসেন। তফসিলীরা ভারতীয় জাতির পিতা মৃত্যুর কলংক নিতে চান নাই। তারা স্বাধীন মতের একটা সুযোগ উচ্চ বর্ণের গান্ধীজীর জন্য ত্যাগ করছেন। এটা সোনার অক্ষরে লেখা থাকার কথা। লেখা হয় নাই। হওয়া সম্ভব না। কারণ, ছলে বলে কৌশলে অধিকারহরণের  চেষ্টা আজকের নয়। তার সবগুলো মানবতার জন্য। আপাত প্রচার অহিংস আসলে হিংস্র। অপরের রক্ত চুষে খাবার বাসনা। সে বাসনা নিয়ে যাবে সহিংসতার দিকে।

মানবতা আর সার্বজনীনতা এইসব শব্দ অহিংসতার মোড়কেই আসে। ছড়ায় সহিংসতা। এই মোড়কে ন্যায়যুদ্ধ বলে একটা জিনিসও আছে। সে পাপ বাসনাকে পূরণ করে। আজকের বাংলাদেশে মোল্লাদের প্রতি চলছে অহিংস ঘৃণার চর্চা। যে তত্ত্বের মধ্য দিয়ে ঘৃণার চর্চার করা হয়, মানতে হবে তার মধ্যে সামগ্রিকতার গরহাজির আছে। নায্যতার সমাধান ঘৃণা দিয়ে হয় না। বিদ্যমান ব্যবস্থার মধ্যে শত্রু-মিত্র সবার জন্য দয়া-মায়ার বিষয় থাকবে। যখন আপনি কাওকে ঘৃণা করেন- তা খণ্ডিত দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই আসে। হোক সেটা  মানবতার নামে। ইরাক-আফগানিস্থানে বোমা মারা হয় মানবতার জন্য। দুইটার মধ্যে আসলে ফারাক নাই। দুইটাই অপরকে শত্রুজ্ঞান করে যেকোন মোড়কে ঝাড়-বংশে উচ্ছেদ করা। অপরকে বুঝতে না চাওয়ার খাসলত। সেটা বাংলাদেশের প্রায় সব পক্ষই করে।

দুনিয়া ঠিক সবসময় এই রকম না যে, একপক্ষ ছলে বলে কৌশলে মারে, অন্যরা তাকাইয়া থাকে। দুইপক্ষই  সহিংস হয়ে উঠে। সেখানে হিংস্রতার স্বভাবগত অর্থ অপরের মাঝে ছড়িয়ে যায়। সমাজে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। একের চিন্তার ভার অপরে এইভাবে গ্রহন করে।

এরচেয়ে আমরা আরো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে নজর দিতে পারি। স্বীকার করে নিই এই প্রশ্নের কোন উত্তর আমার কাছে নাই।

ভেতরে ঘৃণার চর্চা, উপরে অহিংসার মোড়ক দিয়ে আসলে কি হয়! অপরাধীকে শাস্তি দেয়া ঘৃণার বিষয় নয়। বিচার ঘৃণার উপর নয়, নায্যতার উপর দাড়িয়ে থাকে। নায্যতার চেষ্টা যদি সামগ্রিক হয়, ঘৃণা চর্চার কোন মোড়ক লাগে না। তাই বলে ঘৃণার উপর ভর করে যে দাবি তার বিচারের জায়গায় নায্যতা হারায় না। ঘৃণা হলো পক্ষপাতের বিষয়, নিজের দিকে না তাকানো। আমিই সব, আমার সংস্কৃতিই সব, এগুলোই শ্রেষ্ট। এর বাইরে আর কিছু নাই। এরা নিজের শ্রেণিস্বার্থের বাইরে এক পাও আগাই না। সমাজ দেহকে বুঝতে না চাওয়ার অনীহাতে তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের জয়।

যে মোড়কেই হোক হিংস্রতার চর্চা আমাকে করতে হচ্ছে। মানুষ শুধুমাত্রই হিংস্র- এমন বচনেও বিশ্বাস করছি না। তবে, এই যে হিংস্রতা তা মানুষের অপরাপর বস্তুর মতো স্বাভাবিক। এর প্রকাশ ঘটাও স্বাভাবিক। হিংস্রতারে গালাগালি করলে এর খাসলত পরিবর্তন হয় না। একে বরং জীবনযাপনের মধ্যে নিরাময় ও আত্মস্থ করতে হবে। তার প্রথম কাজ হতে পারে মোড়কের বাইরে তার রূপ খোলাসা করা। তবে খোলাসা করলে একইরূপ পাওয়া যাবে কিনা- তাতে সন্দেহ আছে। এটা স্বীকার করা গুরুত্বপূর্ণ যে, এর বসত আমার ভেতরই। নাই বলে কোন ধরণের সমাধানে পৌছা যায় না। ব্যক্তি, সমাজকে একটা সমগ্রের ভেতর ধরে বিচার করা দরকার। খাসলতকে অবদমন নয়, সমাজ দেহে তার প্রকাশটা কেমন হবে সেই রূপটায় ভাবা গুরুত্বপূর্ণ।

আজ এটুকুই। ইচ্ছেশূন্য মানুষের পাঠকদের ধন্যবাদ। তারা ভালোবাসেন বলেই আমরা একশতম পোষ্টে পৌছে গেছি।

Comments

comments

5 thoughts on “হিংস্র, অহিংস, সহিংস

  1. পরে বিস্তারিত লিখার ইচ্ছা রইলো। মোটেই ইচ্ছাশূন্য মানুষ নই বলেই। আপাতত এটুকু: মানুষকে সভ্য হতে আরো সময় লাগবে।

  2. মাঝে মাঝে ভাবি, আসলে আমরা কোথায়? এই দেশের মানুষ কি সত্য মানুষ হয়েছে! উত্তর খুঁজে পেতে দেরী হয় না। হিংস্র, অহিংস, সহিংস যাই বলেন না কেন, সব কিছুতেই স্বার্থ!

    (১০০তম পোষ্টের জন্য বিশেষ বিশেষ শুভেচ্ছা, লিখতে থাকুন।)

Comments are closed.