চোরাবালি: মুভিটি হিট হোক

182391_2657808942409_2114130098_nব্যবসায়ের মানদন্ডে চোরাবালি হিট না ফ্লপ্ সেটা আলোচনা করা যেতে পারে নানা তরফে। তবে এই আলোচনা সে তরফে না। মুভি শেষ হওয়া মাত্রই বলে উঠলাম ‘মুভি হিট’। এই কথা বিশেষ কোন ব্যক্তি নয়, বরং ব্যক্তিসমূহের একজন বলছে। এই ব্যক্তি বিশেষ কোন সময়ের ব্যক্তি। চোরাবালি হিট- সোজা সাপটা বললে- এই সময়ের তরুন দর্শকরা যা চায় তার কিছু না কিছু চাহিদা পূরণ করে নির্মিত। উল্লেখ, তারুণ্য বয়সজনিত মাপকাঠি নয়।

চোরাবালির ভিজুয়াল একপেরিসেন্স এই সময়ের দর্শকের জন্য অতিপ্রত্যাশিত। কিন্তু গড়পরতা বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে এটি অপ্রত্যাশিত।

রেদোয়ান রনি বেশ কয়েক বছর যাবত টিভি নাটক বানাচ্ছেন।  টিভি নাটকওলার মুভি বানানো এই প্রথম না। এটা খুব সহজ রটনা যে নাটকের পরিচালকের বানানো মুভি হলো বড় নাটক। তারা মুভির ট্রিটমেন্ট দিতে পারেন কিনা তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। অথবা নাটক ও সিনেমার পার্থক্যও গুরুত্ববাহী নয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নাটকের পরিচালক নিজেকে চলচ্চিত্রের পরিচালক হিসেবে আবেদন তৈরি করতে পারছেন কিনা। যা সরাসরি তার ফিল্ম কনটেন্ট ও তার প্রজেন্টেশনকে নির্দেশ করে। এই ক্ষেত্রে রনি একশভাগ সফল। এই নিয়া নানা মুনির নানা মত দেয়া যায়। কিন্তু এই নাম্বারিং-র ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধার প্যাকেজ দিচ্ছি। একই সাথে ভালো চলচ্চিত্র নামে বাণিজ্যিক মুভির সাথে সতীনিপনার যে ধারণা শিক্ষিত সমাজ করে আসছেন তাকে রনি ছাড়িয়ে গেছেন। এই সন্তুষ্টি সত্ত্বেও চোরাবালি কি গতানুগতিক কাহিনীর বাইরে গেছে? এই প্রশ্নের মধ্যে উত্তরের আভাস তো কিছুটা আছে। তারপরও ভিজুয়াল এক্সপেরিন্সের দিক থেকে একে এফডিসি-র মুভির গুনগত টার্নিং পয়েন্ট বলা যায়। তার দুটো দিক, এক. গল্প বলা ও দুই. চিত্রগ্রহন।

বড় ভাই (এ টি এম শামসুজ্জামান) মন্দ আর হায়দার খান (সোহেল রানা) সৎ রাজনীতিবিদ। অন্যদিকে আলী ওসমান চৌধুরী (শহীদুজ্জামান সেলিম) আন্ডারওয়ার্ল্ডের মাফিয়া। আলী ওসমান হায়দার খানকে সরিয়ে রাজনীতিতে আসতে চায়। একই সময় এক মডেল কন্যার সাথে সম্পর্কের জটিলতায় পড়ে আলী ওসমান। তাদের সরাতে ব্যবহার করেন তার পালিত খুনী সুমনকে (ইন্দ্রনীল)। একের পর এক খুন চলে। খুনের রহস্য ফাঁস করার মিশন নেয় সাংবাদিক নবনী আফরোজ (জয়া আহসান)। তাকে খুন করতে যায় সুমন’।

চোরাবালির কাহিনী প্রচলিত গ্রান্ড নেরেশানকে অতিক্রম করে নাই। শুভ ও অশুভের দ্বন্ধই প্রধান। নায়ক-নায়িকার বিপরীতে ভিলেন এই তত্ত্ব থেকে সরেন নাই। সরতে হবে এমনও না। সুতরাং, মোটা দাগে বাণিজ্যিক মুভির সাধারণ ছকে বানানো গল্প। এর মধ্যে কি করে নাটকীয়তা, চমক ঢুকানো যায় সেটা হলো আসল। এই মুভির সংলাপ হিসেবে রাখলে দেখা যাবে প্রচলিত সংলাপ কাঠামোতে বাঁধা। কিছু গালি-গালাজও আছে। ভদ্র শোভন পরিবেশ বজায় রেখে তা আড়াল করা। তাই আসল প্রশ্ন হলো প্রজেন্টেশন কেমন হবে? প্রথমে বলেছি গল্প আর চিত্রগ্রহনের কথা। তার সাথে যুক্ত সময় এবং দর্শক রুচির পরিবর্তন। রনির সেই বিবেচনাবোধ চমৎকার। আণ্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ে তার গল্প চমকপূর্ণ কিন্তু অভিনব নয়। গল্পের মধ্যে দর্শককে বুদ করে রাখার ফমুর্লাও ছিলো। কারণ গল্পের শেষটুকু কি হবে সেটা বোঝার কোন উপায় ছিলো না। বলা যায় গল্পও খুব একটা ঝুলে যায় নাই। ফলে চোরাবালি বুঝতে গেলে আপনাকে কাহিনীর শেষতক অপেক্ষা করতে হবে। এই টেনশন উপভোগ্য। হার্টের জন্য ক্ষতিকর নয়।

264459036997294_2008743142_nমোটাদাগে দুই এক জায়গায় আপনার প্রশ্ন থাকলেও গল্প বলা গেছে এবং শেষ পর্যন্ত বলা গেছে এটা ফিল্মিক মোমেন্ট আকারে চমৎকার। এই শুভ-অশুভের দ্বন্ধের মধ্যে খতম হয়ে গেছেন সৎ রাজনীতিবিদ। আরেক গড ফাদার বড় ভাই বেঁচে থাকেন। তার চোরাফাঁদ থেকে আপনার আমার মুক্তি নাই। এক সময় নায়করা সে মুক্তিদাতার ভূমিকায় থাকতেন। তার ভূমিকা ছিলো সমাজ বাঁচানোর। কিন্তু এই সময়ের স্বাতন্ত্র্যবাদীরা নায়করা এমন না। তাদের জগত নিজেদের মুক্তি নিয়ে।

রনির বর্ণনা এই সময়ের শিক্ষিত, শহুরে এবং মনোগতভাবে শিক্ষিতদের বর্ণনা। রাজনীতি মানে খারাপের মানুষ কাজ। এখানে ভালো মানুষ টিকতে পারে না। এর পজেটিভ ট্রিটমেন্ট সেইসব মানুষের মত এই সিনেমাও নাই। ফলে শ্রেণীগত মনস্তত্ত্বে এই নিমার্ণ বাস্তবানুগ। রনি কোন অর্থে রাজনীতি নিয়ে পজেটিভ মেসেজ দিতে পারেন নাই। এটাকে খারাপ বলব না। দর্শকেরা সিনেমার আয়নায় নিজেদের কল্পনা করতে চাইবেন। তাই দর্শকরা বসে থাকেন নায়কের কাঠামোয়। তাই তাকে শেষ পর্যন্ত পজেটিভই থাকতে হয়। ফলে রনি তার দর্শকের মনোস্তত্ত্ব বুঝেন বলে বাহবা দিতে হয়। সেই ক্ষেত্রে অন্ধকার জগত থেকে সুমনের পিছলে আসা আধুনিক মানবতাবাদের চমৎকার রূপায়ন। সুমন অনেক খুন করে। কোনটায় তার বোধকে জাগায় নাই। কিন্তু গর্ভবতী মাকে হত্যা তাকে বদলে দেয়। কিছুটা কৌতুককর তো বটে। এটাই মানবিকতার স্টান্টার্ড।

Capture1দ্বিতীয় বিষয়টি হলো চিত্রগ্রহন। বাণিজ্যিক মুভিতে বাংলাদেশে এতো ভালো চিত্রগ্রহন আগে দেখেছি বলে মনে হয় না। প্রযুক্তির দিক থেকে গত দুই বছরে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে আশা জাগানিয়া কিছু কাজ হয়েছে। অনন্ত জলিলের প্রযোজনা এবং জাজ মিডিয়ার ডিজিটাল প্রজেকশন সিস্টেমকে বলা যায় টানিং পয়েন্ট। কিন্তু সেই অর্থে ভালো আউটপুট পাওয়া যায় নাই। চোরাবালির চিত্রগ্রহন, এডিটিং ও কালার গ্রেডিং অসাধারণ। আলো-আধারী, ফ্লাশব্যাক বেশ দ্যোতনাময়। আবহ সংগীত ভালো, মুহুর্তগুলোকে আরো টানটান করেছে। সাথে ছিলো মানানসই ও ঝকঝকে লোকেশান। ঢাকা শহরের চমৎকার সব বার্ডস আই ভিউ তো আছে।

ভিলেন চরিত্রকে কিছুটা মানবিক করে দেখাতে চেয়েছেন। এটা নতুন মাত্রা দিয়েছে। দর্শক হিসেবে হিউমারের আড়ালে নিজেদের ভেতরকার ভিলেনিপনাকে বেশ ভালোই উপভোগ করেছি। অদ্ভুত যে এই মুভিতে ভিলেন ছাড়া সবাই সিরিয়াস। কেউ হালকা নয়। এটা দুর্বলতা বটে। শহীদুজ্জামান সেলিম অসাধারণ অভিনয় করেছেন। সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে।  ইন্দ্রনীল ভালো করেছেন। চরিত্র নিয়ে কোন দ্বিধা ছিলো না। তার স্মার্টনেস আইকনিক। হতাশ করেছেন জয়া আহসান। তাকে দেখতে ভালো লেগেছে। কিন্তু সাংবাদিক চরিত্রে যথাযথ মনে হয় নাই। মনে হচ্ছিল একজন অভিনেত্রী স্ক্রিনে ফর্মুলা মাফিক হাঁটা চলা করছেন । শেষের দিকে ভালো করেছেন। ভালো লেগেছে প্রযোজক সালেহীন স্বপন ও পিয়ার অভিনয়।

এই মুভিকে কিছু জায়গায় নাম্বার দেয়া যায় না। একশান দৃশ্যটির শুরুর দিকটা ভালো লাগে নাই। চমৎকার কিছু কম্পোজিশন থাকা সত্ত্বেও গানের ব্যবহার সঠিকভাবে হয় নাই। দুই এক লাইনের বেশি কোনটায় শুনা যায় নাই। যেটা মুভির বাণিজ্য বিস্তারেও সমস্যাজনক। বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে গান অনেকটা আরাম দেয়। রনি সম্ভবত সেই স্টোরিওটাইপ জায়গা থেকে সরে আসতে চান। যদি চানই আইটেম গানের দরকারটা কি? আলী ওসমান চৌধুরী বাড়ির সামনে সাংবাদিক দেখে রেগে সাগরেদকে বলছেন, ‘উচা কইরা স্টেজ বানাইয়া দে, নাচি মুন্নী বদমান হুয়া ডার্লিং তেরে লিয়ে’। অর্থ্যাৎ, আইটেম সং সম্পর্কে একটা ধারণা পরিচালকের আছে। কিন্তু এডিটিং আর গানের বিটের সাথে সম্বন্বয় না থাকায় আইটেম সং-ই এই মুভির সবচেয়ে মাইনাস পয়েন্ট। শুধুমাত্র বুক আর নাভি দেখালেই দর্শক টানা যায় না। অথবা গোড়ার প্রশ্নই করি আইটেমের সং-র দরকার কি? বাংলাদেশে ভালো গল্পের দরকার আছে। উন্নতি প্রযুক্তির দরকার আছে। সবই ছিলো- তাইলে এই ছাইফাস দিয়ে কলঙ্কিত হওয়া কেন?

এই এক্সপেরিয়েন্স দর্শক ও নির্মাতাদের নতুন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। দর্শকদের প্রত্যাশা বেড়েছে। আশা করা যায়, বাংলাদেশি মুভি সেই চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা ভালোভাবেই করবে। সবশেষে এক কথায় বলা যায়, চোখের আরাম দরকার আছে। চোরাবালি চোখের জন্য ভালো। কানের জন্য আরামদায়ক। আসুন দর্শকেরা দলে দলে চোরাবালি দেখি। মুভিটি হিট হোক।

আরো পড়ুন:>  ইচ্ছেশূন্য মানুষ: মুভি

>ব্যবহৃত ফটো: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত।

Comments

comments

20 thoughts on “চোরাবালি: মুভিটি হিট হোক

  1. দারুনভাবে একটা পজেটিভ রিভিউ দিলেন সুজন ভাই।

    আইটেম গান দিয়া আমজনতারে আকর্ষন করার চেষ্টা করা হয়েছে মনে হচ্ছে…

    খুশি লাগছে এইজন্যে যে,রনি তাইলে ভাইবেরাদরগো মতন সিনেমারে নাটক বানায়া ফেলেনাই।সিনেমাই বানাইছে।ধন্যবাদ রনিকে।
    তার কাছ থেকে আমরা নিয়মিত সিনেমা আশা করছি…এইসব তরুন তূর্কিদের হাত ধরে আমাদের সিনেমা আবার তার হারানো গৌরব ফিরে পাক সেই কামনা করছি!

    ধন্যবাদ!

    আপনার সাইট ফলো করি…কিন্তু কমেন্ট এই প্রথম করলাম!

    • ”খুশি লাগছে এইজন্যে যে,রনি তাইলে ভাইবেরাদরগো মতন সিনেমারে নাটক বানায়া ফেলেনাই।সিনেমাই বানাইছে।ধন্যবাদ রনিকে।
      তার কাছ থেকে আমরা নিয়মিত সিনেমা আশা করছি…এইসব তরুন তূর্কিদের হাত ধরে আমাদের সিনেমা আবার তার হারানো গৌরব ফিরে পাক সেই কামনা করছি!”

      আপনার সাথে একমত পোষণ করছি।
      চোরাবালি যে সম্ভাবনা দেখিয়েছে তাতে পজেটিভ রিভিউ অবশ্যই প্রাপ্য। আমি অবশ্য কখনো নাক উচুঁ ভাব করে বাংলাদেশি মুভি নিয়া লিখি না। কারণ মুভি যতই ভালো জায়গায় পৌছাক না সেটা অতীতের ধারাবাহিকতা। একই সাথে সেটা আমাদেরই ধারাবাহিকতা।

      সাইট ফলো করছেন জেনে ভালো লাগল।
      শুভ কামনা।

  2. চমৎকার রিভিউ……..মুভিটা দেখার আগে একটু একটু ভয় ভয়ই লাগছিলো………যে প্রত্যাশা নিয়ে গিয়েছিলাম সেটি পূরণ হবে কি হবে না সেই ভয়…………আমার কাছে সবমিলিয়ে মুভিটি খুব ভালো লেগেছে………একদম সত্য কথাটাই বলেছেন…………এই মুভির আসল মজাটা হলো সেলিমের অভিনয় দেখার অভিজ্ঞতা……….ক্লাস অভিনয় করে গেছেন………..

    • মুভিটি দেখার সময় আমারও ভয় লাগছিল। কারণ এই মুভি সফল হলে অন্যরা উজ্জীবিত হবে। সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। আশা করছি এই মুভি হিট হবে।

    • সাহাদাত ভাই,
      খেয়াল করেছি সিনেমা পোষ্টে কেমন যেন মন:কষ্ট নিয়া কমেন্ট করেন।

      ঘটনা জিগেশ না করি। সবসময় ভালো থাকুন এই চাই।

      • ছবি দেখা হয় না বললেই চলে। আমার ছেলেটা অনেকদিন ধরে বলছে হলে নিয়ে ছবি দেখাতে আমি সময় বা নানান কারনে তা পারছি না, সে জন্য হতে পারে।

        ছবি দেখার যে সময় লাগে তা বের করা কষ্টকর। আর তিন চার ঘন্টা হলে বসে থাকাও এখন চিন্তা করতে পারি না… হা হা হা।।

        ব্যাপার না, একদিন হলে বা সিনেকমপ্লেক্সে ঢুকেই পড়ব।

        ভাল থাকুন…।

        • ভালো থাকুন।।

          ভাতিজারে স্পাইডার ম্যান টাইপের কিছু দেখাতে পারতেন। তার ভালো লাগত। বিশাল পর্দায় সুপারহিরো উড়ে যাচ্ছে।

  3. ভালো রিভিউ। সময় পেলে একবার দেখে এসে আপনার সাথে মিলাবো। আর যদি দুইটা টিকেট গিফট করেন তবে সময় বের করে দেখে এসে আপনার পোস্টে আবার কমেন্ট করবো।

  4. আপনার আর দারাশিকো ভাইয়ের লেখা পড়ে নিজের লেখাটা ছাইপাশ বলে মনে হচ্ছে 🙁
    আইটেম গানের ব্যাপারে একদম সহমত। প্রযোজক সালেহীন স্বপনের অভিনয় মোটেও ভাল্লাগে নাই।
    জয়াকে সিনেমায় চরিত্র গ্রহণে আরেকটু সতর্ক আর মনোযোগী হতে হবে। ভার্সাটাইল অভিনেত্রী হতে গিয়ে দুর্বল চরিত্রে অভিনয় করার কোন মানে হয়না।
    খুশির সংবাদ বাংলা চলচ্চিত্রে সুদিন ফিরে আসতে শুরু করেছে 🙂

    • শুকরিয়া। শেষ পর্যন্ত মন্তব্য করতে পারলেন।

      ছাইপাশ………ঠাট্টাটা বেশি কঠিন হয়ে গেল না। 🙁

      হুমমম.. সুদিন হইলে তো ভালোই।

  5. বাহ! অসাধারণ। আমি লেখার জন্যই সিনেমাটা দেখেছিলাম। খুব ভালো লিখেছেন।

Comments are closed.