মুক্তি মণ্ডলের উম্মাদ খুলির পৃষ্ঠাগুলি

উম্মাদ খুলির পৃষ্ঠাগুলি। মুক্তি মণ্ডল। প্রথম প্রকাশ একুশে বইমেলা ২০১১। আবহমান প্রকাশনী লিমিটেড, ঢাকা। প্রচ্ছদ সব্যসাচী হাজরা। দাম একশত টাকা। পৃষ্টা চৌষট্টি।

মানুষের মুখের দু পাশে দু রকম জালছাপ দেখি- একপাশে মৃত্যুদূত/ হাতে ফুল। অন্য পাশে বাঘিনীর বিক্ষিপ্ত হাসি আর বন্য ফুলের গন্ধ/ আমরা দেখি আমাদের আত্মার মধ্যে উড়ছে ঈগল। তার পাখার হাওয়ায়/ কয়লার পাহাড় কাপে। বিচিত্র তৃঞ্ষার হাড়ে জম্ম নিচ্ছে ফুল। কখনও/ কখনও জলকাচে সমুদ্রের দুর্বিনীত মুখ ভেসে ওঠে। [যাই অস্তমিত সূর্যের আলোর নিচে, পৃষ্ঠা ২৬]

সূচবর্ষার শব্দে ফের তলিয়ে যেতে যেতে ওই মুখের মতো আপেলে সত্যিই/ সহাস্যে লাফিয়ে ওঠে আমাদের অন্তর। বিষাদ ও বিরহের মাঝখানে/ আমরা গোলাপের শুকনো পাতায় ছড়িয়ে যেতে দেখি নৈশব্দ্য, খনিশ্রমিকের হাহাকার। [উড়ো মুখের দিকে, পৃষ্ঠা ২২}

উম্মাদ খুলির পৃষ্ঠাগুলি মুক্তি মন্ডলের তৃতীয় কবিতার বই। এই সময়ে যারা কবিতা  লিখছেন মুক্তি মণ্ডল তাদের অন্যতম। তার কবিতা ভাবনা, নির্মাণ ও গন্তব্যের মধ্যে শক্তিশালী বাধন আছে, যা সহজে আলগা হবার নয়। শব্দ চয়নে সাবধানী। বিশেষ ভাবনায় অন্তপ্রাণ। নিজেকে কবিতার নির্বিশেষ জগতে সমর্পন করলেও বিশেষ বিশেষ শব্দের ব্যবহার ও অর্থের মধ্য দিয়ে  আপন বিশেষত্ব অর্জন করেছেন।

কয়েক দিন যে শহরে থাকব না, তা জানান দেবার কৌশল হিসেবে/ সমস্ত দৈনিকগুলোতে পাঠিয়েছি শহুরে পাখিদের বিষ্ঠা। প্যাকেটের গায়ে/ লিখে দিয়েছি ‌সাবধান। রোদভরতি ডুমুর গাছের তলে পাঠিয়ো না কোনো মিথ্যেবাদী প্রতিবেদক, সুশীল জাহাজ। [শহর ছাড়ার নোটিশ, পৃষ্টা ১৪]

ভেজা এক ফালি কাঠের ফাকে/ পুরানো দিনের রোদ/ উজ্জ্বল খলো দেখো পেরেক বিদ্ধ/ প্রথিত নৈশ স্মৃতি। [গোধূলির বন, পৃষ্ঠা ৩০]

তার লেখায় ঘোর আছে কিন্তু তা প্রধান হয়ে দাড়ায় না। কথার খেলা আছে, কিন্তু সেটা ফেনায়িত না। আছে কথা বলার উচ্ছল ইশারা।  সেই ইশারা নিজস্ব গতিতে খুজে নেয় আপন সমুদ্র। তাকে পাড়ি দিতে হয় নানান অভিজ্ঞতার চৌকাঠ। সেটা যদি পাঠককে নিয়ে যায় আপন গতির অভিমুখে, পাঠক তখনই নিজেকে আবিষ্কার করে কবিতায়  নির্মিত জগতে। কিন্তু সে পর্যন্ত যাওয়ার ফুসরত তো থাকা চাই। পাঠকের সেই সমুদ্র পর্যন্ত ভেসে যাওয়ার ফুসরত মুক্তি মন্ডল টিকিয়ে রাখেন। এই সময়কার কবিতার বিরাণ ভূমিতে এটা বড়ো সাফল্য। সেই বিরাণ ভূমিতে তিনি বলে চলেন মানুষ, সমাজ, প্রকৃতি আর তার অপরাপর সম্পর্কের কথা। এর মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দৈনন্দিন জীবন যাপন, স্মৃতিকাতরতা, নিজেতে উতরে যাওয়া, রাজনীতি, ধর্ম, মিথের বর্ণিল জগত। সেখানে অপর বলে কিছু নাই। বরং, বিষয় আর বিষয়ী একে অপরকে ফুড়ে বাহির হয়ে আসে। বস্তু তার আপন গুণে ব্যক্ত হয়। এই বাহির করে দেখানোতেই মুক্তি মন্ডল স্বার্থকতা।

আজ আসো তুমি। আমাদের পাজরগুলো জোড়া দিয়ে ফিরে যেয়ো। আমরা যে ভাষায় কথা বলি,ওই ভাষায় একটু চোখ টিপে হেসে দিয়ো। আমাদের মুন্ডু বেয়ে রক্ত গড়িয়ে গেলে তুমি স্নান সেরে- আবার তৈরী করতে থেকো মেঘের মুখোশ। [ঝলক ও মেঘের মুখোশ,  পৃষ্ঠা ১৮]

মুক্তি মণ্ডলের এই কবিতায় একটি শব্দের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। শব্দটি নানা কবিতায় ঘুরে ফিরে এসেছে। যেমন-  মুখোশ শব্দটি অনন্ত স্পর্ধার ব্লেড, উজ্জ্বল মুখ, ঝলক ও মেঘের মুখোশ, মিনতি, পোকা ও কাঠকয়লা, জড়াজড়ি, দেখা প্রভৃতি কবিতায় ঘুরে-ফিরে এসেছে। মুখোশ শব্দটির মিথিক বৈশিষ্ট্য গুরুত্বপূর্ণ আবার মানব চরিত্রকে ভিন্ন ভিন্নভাবে ধারণ করে। তার নানা কবিতার মধ্য দিয়ে শব্দটি বিশেষ বিশেষভাবে এসেছে। নিবিষ্ট পাঠক এই শব্দের মধ্য দিয়ে পৌছে যায় নানা রূপ ব্যাঞ্জনায়। একটি শব্দ স্থান-কাল-পাত্রে কি করে নানা অর্থ তৈয়ার করে তার উত্তম  উদাহরণ। অন্যদিকে পাজরের মতো অতিব্যবহৃত শব্দ নতুন কোন অর্থ ছাড়াই ব্যবহৃত হয়েছে এই বইয়ে সংকলিত নানা কবিতায়।

বিয়োগিনী, এইবার চিরে ফেলো মধুসন্তাপের দেহ/ দীর্ঘ ছায়ার নৃত্যে ছুড়ে দেওয়া কটাক্ষ ফিরে এসে/ দ্বিধার পালকে বসুক। তার ঘুমহীন চোখে আমাদের/ আকাঙ্ক্ষা/ আমাদের কালো মেঘ, উড়ুক। [বিয়োগিনী, পৃষ্ঠা ২১]

কবে আসবে মুখর সেই ক্ষণিকের শুকনো পাতার মচমচ/ ম্যাচবাক্সের খালি খোলের ভেতর নেচে উঠবে/ প্রথাবিরোধের চঞ্চলতা/ ধীরে ধীরে ছিন্ন হবে কাঠি থেকে আলোর প্রভাব [বাঙালি মনন, পৃষ্ঠা ৪৩]

ছৌষট্টি পৃষ্টার বইটিতে কবিতা আছে ছাপ্পান্নটি। মানব জীবনের নানা অভিজ্ঞতার নিপুন অভিজ্ঞানের কবিতাগুলো কবিতাপ্রেমীদের ভালো লাগবে।

> লেখাটি রাজনৈতিক.কম-এ পূর্ব প্রকাশিত।

Comments

comments

11 thoughts on “মুক্তি মণ্ডলের উম্মাদ খুলির পৃষ্ঠাগুলি

  1. মুক্তি বাবুর লেখা অসম্ভব ভালো। ঘুমন্ত মেধাকে ধনাত্বক উষকে দেয় ।

Comments are closed.