ঘেঁটুপুত্রের বনবাস

সংলাপ, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা:
হুমায়ূন আহমেদ
প্রধান সহকারী পরিচালক:
জুয়েল রানা
সুর-সংগীত:
মকসুদ জামিল মিন্টু, এস আই টুটুল
আবহ সংগীত:
ইমন সাহা
কোরিওগ্রাফার ও প্রডাকশন ডিজাইনার:
মেহের আফরোজ শাওন
গান গেয়েছেন:
ফজলুর রহমান বাবু, শফি মণ্ডল, প্রান্তি
গান লিখেছেন:
হুমায়ূন আহমেদ, শীতালং শাহ, সংগ্রহ
শুটিং স্পট:
হরিপুর জমিদারবাড়ি ও নুহাশপল্লী
প্রযোজনা:
ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লিমিটেড
চিত্রগ্রাহক:
মাহফুজুর রহমান খান
অভিনয়ে:
তারিক আনাম খান, মুনমুন আহমেদ, আগুন, আবদুল্লাহ রানা, শামীমা নাজনীন, তমালিকা কর্মকার, প্রাপ্তি, প্রান্তি, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, প্রাণ রায়, মাসুদ আখন্দ, রহমত আলী, পুতুল, কুদ্দুস বয়াতি প্রমুখ এবং নাম ভূমিকায় মামুন
রিলিজ:
৭ সেপ্টেম্বর ২০১২
দৈর্ঘ্য:
১ ঘন্টা ৪৫ মিনিট
বিশেষ সতর্কতা:
শিশুদেরকে না দেখানোর অনুরোধ

কমলার বনবাস গ্রাম-বাংলার জনপ্রিয় কাহিনী। এ নামের যাত্রাপালা ও চলচ্চিত্র আছে। হুমায়ুন আহমেদ তার ঘেঁটুপুত্রের নাম কেন কমলা রাখলেন তা জানার উপায় নাই। কিন্তু এ কমলা নিছক নামই নয়- বরং কমলার সাথে বনবাসের কথাই কেন জানি মনে করিয়ে দেয়। যে তিনমাস হাওরে পানি থাকবে- সে তিনমাস জহির (মামুন) কমলা সেজে জমিদারের (তারিক আনাম খান) মনোরঞ্জন করবে। আক্ষরিক অর্থে এ তিনমাস জহির কমলা হয়ে বনবাস করে। এ বনবাসের শুরু বা শেষে রোমান্টিক কিছু নাই। কমলা শিকার জমিদার শিকারী। তবে টাকার বিনিময়ে। সব নিপীড়ন হয়তো আয়োজন করে হয় না কিন্তু ঘেঁটুপুত্র..। সে এলাহী আয়োজন।

যেসব শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়- তাদের অনেকে সারাজীবন  ভয়াবহ স্মৃতি বয়ে চলে। কাউকে বলতে পারে না। শুধু তা-ই নয়, তাদের জীবনাচারে অস্বাভাবিক অনেক কিছু ঢুকে পড়ে। তাদের কাছে সারা জীবনটাই বনবাস।  ঘেঁটুপুত্র কমলা চলচ্চিত্র নিয়ে অনেকের মাঝে আগ্রহ দেখা গেছে। এর একটা কারণ হুমায়ুন আহমেদের প্রয়াণ। অন্যটি চলচ্চিত্রর বিষয়বস্তু। হুমায়ুন আহমদ খুব যে সহজ পথে হেঁটেছেন তা নয়। বিতর্ক হবে জেনেও তিনি এ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন তার জন্য আমরা তার কাছে কৃতঞ্জ থাকতে পারি। চলচ্চিত্রটি নিয়ে কিছু বলার আগে গেঁটু গান সম্পর্কে দুই এক কথা শোনা যাক-

গাঁটু বা ঘাঁটু না গাঁডু সে বিতর্কে যাবার খুব একটা দরকার নাই। একটা কাহিনী দিয়ে সংক্ষেপে বলা যাক। ১৬ শতকের প্রথম দিকে তৎকালীন শ্রীহট্টের আজমিরীগঞ্জের জনৈক আচার্য রাধা যেভাবে কৃষ্ণের জন্য পাগলপারা হয়ে ছিলেন- তেমন বিরহভাবে ব্যাকুল হয়ে সংসার থেকে উধাও হয়ে যান। কয়েক বছর পর ফিরে এসে বাড়ির সামনে পুকুরের ধারে একটা কুঞ্জ বানান। সেই কুঞ্জে বিরহিণী রাধার মতো মথুরাবাসী কৃষ্ণের অপেক্ষায় থাকতেন। ভাবাবেগে অধীর হয়ে তিনি ফুল তুলতেন, কুঞ্জ সাজাতেন, কখনো কলসী কাঁখে জল আনতে যেতেন, কখন বা প্রাণবেনুর রব শুনে শিষ্য উদয় আর্চাযের গলা জড়িয়ে কাঁদতেন, কখন বা কোকিলার কুহু তানে আপনাকে হারিয়ে ফেলতেন- তন্ময় হয়ে পড়তেন।

ক্রমে তার শিষ্য বাড়তে থাকে। সমাজের নিম্মশ্রেণীর লোকেরা এসে জড়ো হয়। তাদের কম বয়েসী ছেলেরা এই গানে অংশগ্রহন করে নারীবেশে। উদয় আর্চাযের সংস্কারে এটা পালাগানে পরিণত গয়। এই পালাগান নানা অন্কে বিভক্ত। নিজস্ব ধারা তৈরি হয়। আচার্যের মৃত্যুর পর সুন্দর কিশোরদের নারী সাজিয়ে বিরহ বা ঠাট্টার ছলে বিশেষ ধরণের ইঙ্গিতই প্রধান হয়ে উঠে। ঘেঁটুপুত্র হওয়া ধর্ম নির্বিশেষে পেশা হয়ে দাঁড়ায়। উমর আলী আর সুরেন্দ্রচন্দ্র নমদাস নামে দুইজন গাঁটুর মাসিক আয় ছিলো তিনশত টাকার উপরে। বলা হয়ে থাকে এই দুই ঘেঁটুপুত্রের বিলাসিতা অনেক টাকাওয়ালা ব্যক্তিকে সর্বস্বান্ত করেছে।

এভাবে আধ্যাত্মিক ভাবের খবর চাপা পড়ে গেল। সময়ের সাথে এ অনৈতিক উদযাপনও উঠে গেল। কিন্তু শিশুদের প্রতি আকর্ষণজনিত বিকৃতি উঠে যায় নাই। সে প্রথার কদর্য রূপটিই হুমায়ুন আহমেদ তার গেঁটুপুত্র কমলায় তুলে এনেছেন। এ গানের আধ্যাত্মিক মহিমার কোন তুলনা এই চলচ্চিত্রে না থাকায় মনে হয় ঘাঁটু গান মানেই বুঝি খারাপ কিছু।

এবার চলচ্চিত্রের কাহিনী ও নিমার্ণ প্রসঙ্গে যাওয়া যাক। হুমায়ুন তার স্বভাবী বয়ানে এগিয়েছে। শুরু থেকে প্রতিটি চরিত্রের উপস্থাপনে তিনি বরাবরের মত চমক দিয়েছেন। এমন কি ঘেঁটুপুত্রের আবির্ভাব, সাজ-গোজ সব কিছুতেই মজাটুকু ছিলো। তখন ভয় হচ্ছিল- ঘেঁটুপুত্রই না শেষ পর্যন্ত কোন মজার খোরাক হয়ে পড়ে। দর্শকের হাসি ও তালি আশংকা বাড়িয়েই দেয়। কিন্তু ঘেঁটুপুত্রের চিৎকারে যখন জমিদার বাড়ি কেঁপে উঠে তখন পিনপতন নিরবতা। কমলা যখন পরদিন সকালে মায়ের কাছে যাবার আকুতি জানায় খুব কম দর্শকই বোধহয় আবেগী হয়ে পড়ে নাই। আর যাদের জীবনে এমন যন্ত্রণাময় স্মৃতি আছে- তাদের কথায় বাদ দিলাম। কমলা  নাচের মাষ্টারকে (প্রাণ রায়) যখন বলে- গায়ে হাত দিবেন না। কি অদ্ভুত যন্ত্রণা। যার এই স্মৃতি থাকে, তার কাছে চিরকালই কি অপর পুরুষের হাত আগুনের মত ছ্যাকা দেয়া কিছু। এই একটা সংলাপ দিয়ে হুমায়ুন অনেক কিছু বুঝিয়েছে দিয়েছেন। মাষ্টার যখন বলে, তারও ঘেঁটুর জীবন ছিলো। তখন বিষাদ আরো গাঢ় হয়। আরেকটি দৃশ্যে কমলার কাতর ধ্বনির সাথে এক হয়ে যায় আটা পেষার দৃশ্য।

ঘেঁটুপুত্র কমলা চরিত্রে মামুন

জমিদার চরিত্রে তারিক আনাম খান

হুমায়ুন হাওর এলাকার বর্ষাকালীন কর্মকান্ডকে একটা যৌক্তিক ছাচেঁর মধ্যে ফেলে দেখতে চেয়েছেন। সে প্রেক্ষিতে জমিদারের জবানে সৌখিনদার মানুষের ঘাঁটু বিলাসের কথা জানা যায়। সৌখিনতা সাধারণত প্রশ্রয় সূচক। তাই দর্শকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে শিশুকামীতাও সেই প্রশ্রয়ের বিষয় কিনা। ইতিমধ্যে সে প্রশ্ন এসেছে। সে জবাব এই চলচ্চিত্রতে ভালোভাবেই আছে। শিশুকামীতাকে সৌখিনতার সাথে এক করলে তার ফল উণ্টো, বরং বলা যায়, প্রবৃত্তিগত বিকৃতি। হুমায়ুন তার নানা লেখাতে বলেছেন সুন্দর বালিকার জীবন যেমন বিপদের মুখোমুখি তেমনি বালকেরও। হিমুর সিরিজের সর্বশেষ বইতেও এমন একটা ঘটনা আছে। এই চলচ্চিত্রে জমিদারের সহিস চরিত্রটি গুরুত্বপূর্ণ। এ অভিনেতার নাম জানা না গেলেও তার সামান্য উপস্থিতি অসাধারণ। তার ভেতরও সৌখিনতার ইচ্ছে জাগে- এই ইচ্ছে আসলে শিশুদের উপর অত্যাচারের। অর্থ্যাৎ, একটা খারাপ জিনিসেরও দোহাই থাকে- যে দোহাই দিয়ে একে জায়েজ করে নেয়া যায়!

এবার আসা যাক কাহিনীর মোড়ে- প্রথম অর্ধেক শেষ হয় ঘেঁটুপুত্রকে মেরে ফেলার চক্রান্তের মধ্য দিয়ে। জমিদারের স্ত্রী (মুনমুন আহমেদ) তার দাসী সর্দারণীকে (শামীমা নাজনীন) দিয়ে কমলাকে খুন করাতে চান। এ অংশে এসে কাহিনী অনেকটা ঝুলে গেছে। কমলাকে খুনের নানা চেষ্টা দিয়ে এটাকে টান টানভাবে দেখানো যেতো। তার বদলে হুমায়ুন মনোযোগ দিয়েছেন পরিপার্শ্বিক দৃশ্যায়নে। অর্থ্যাৎ, হাওরের অলস তিনমাসকে নানাভাবে দেখানোর চেষ্টা। আছে। যেমন- এইসময় মানুষ নানান ধরণের আমোদ ফুর্তি করে বেড়ায়।জমিদারও। জুয়ার আসর, মোরগ লড়াই দিয়ে সেটা বুঝানো গেলেও কাহিনীর প্রেক্ষাপটে আরেকটু বেশি কিছু দাবী করে। এটাকে খুব একটা খারাপ হয়েছে- বলা না গেলেও সিনেমাকে টানটান করা গেলে ভালো হতো। বিশেষ করে দর্শক যখন আগে থেকেই জানে কমলা মারা যাবে- তাই এটা কোন বিশেষ চমক নয়। বরং, এই মৃত্যুকে আরো করুণ সুরে আকাঁ যেত। কেমন যেন তাড়াহুড়োর ছাপ। বিশেষ একটা চরিত্রকে প্রায় বেকারই দেখা গেছে- চিত্রশিল্পী শাহ আলমের (আগুন) উপস্থিতি। তাকে অবসরে সময়ে ছবি আকাঁনো ছাড়া আরো শক্তিশালী চরিত্র আকারে দেখা যেতো। ঘেঁটুগানের নামে শিল্পের কদর্যতা আর তার নান্দনিক কাজের মধ্যে দিয়ে একটা তুলনা দেখানো যেত। শাহ আলমের সংবেদনশীলতা তার চরিত্রের সাথে মানিয়ে গেছে। তবে সেই তুলনায় স্বল্প উপস্থিতির সহিস চরিত্রটি প্রতিষ্ঠিত।

হুমায়ুনের ‌মাতাল হাওয়া  উপন্যাস ধরে বললে, তার কাছে বড় প্রশ্ন ছিলো কড়া শরিয়তী ও রক্ষণশীল জীবন ধারার মধ্যে এমন একটি বিকারগ্রস্ত আচার কিভাবে টিকে ছিলো। সেই প্রশ্ন আমাদেরও। এ চলচ্চিত্রে ধর্ম সে প্রশ্ন নিয়েই হাজির ছিলো। জমিদার বাড়ির ইমাম সাহেব সবাইকে নামাজের কথা বলে। আজান, ওজু, জামাত ও অন্দর মহলে মহিলাদের জামাত কি নাই! ইমামের আহ্বানের জবাবে সহিস বলে- যে বাড়িতে ঘেঁটুপুত্র থাকে, সেই বাড়িতে নামাজ কিসের। এই প্রশ্নের জবাব ইমাম, হুমায়ুন ও দর্শক কারো জানা নাই। শুধু এইটুকুই বুঝা যায়- ধর্মের চর্চা যখন ক্ষমতার পদানত হলে তার কোন স্পিরিট থাকে না। ইমাম সাহেব যখন কমলাকে বেত দিয়ে মারেন- তখন তিনি আসলে নিজের ধর্মচর্চা ও জমিদারের অনাচারকেই আঘাত করেন। এটা একটা চিহ্নমাত্র। ক্ষতকে আড়াল করার চিহ্ন। প্রশ্ন কই?

এখানে বিবেক হয়ে আসে জমিদারকন্যা ফুলরানী (প্রাপ্তি)। সে একটা প্রশ্নই সবাইকে করে যায়- কমলা ছেলে না মেয়ে। একজন মানুষ একই সাথে কি করে ছেলে ও মেয়ে হয়। সে জবাব আসলে বৃত্তের কেউ দিতে পারে না। কারণ, সবার সাথে কমলার সম্পর্ক এক ধরণের স্বার্থ রক্ষার বা বিরোধের। মা (তমালিকা কর্মকার) হোক, বাবা, জমিদার বা জমিদারের বউ সবার কাছে। এমনকি মৌলভীর কাছেও নাই। হয়তো তাই মীমাংসাহীনভাবে কমলাকে চলে যেতে হয়। হুমায়ুন হয়তো সহ্য করতে পারেন নাই বলে কমলাকে এভাবে মুক্তি দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে আমরা এমন মুক্তির বদলে প্রতিবাদ-প্রতিরোধই আশা করি। সে আশা সবসময় পূরণ হয় না।

এ মুক্তি দিতেই যেন হুমায়ুন কৌতুকময় অথচ প্রায় তরঙ্গহীন বর্ণনায় চলচ্চিত্রের প্রথম দৃশ্য থেকে এগিয়েছেন। একদম প্রথম দৃশ্যের জমিদার বাড়ির ছাদে চিত্রশিল্পীর মডেল হওয়া থেকে শেষদৃশ্যে গাঁটু দলের ফিরে যাওয়া বলা যায় একটা মালা তিনি গেঁথেছেন। বলা চলে, হুমায়ুনের চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে শ্রাবণ মেঘের দিনের পর ঘেঁটুপুত্র কমলা-র লোকেশন ও দৃশ্যায়ন পরিকল্পনা চমৎকার লেগেছে। জমিদার বাড়ির বাহিরের চকচকে ভাব দৃশ্যায়নে আলাদা মাত্রা এনেছে। দারুন লেগেছে সেই আমলের উপযোগী নানা পরিবেশনা। দুটি দৃশ্যের কথা আমার বারবার মনে পড়ছে। একটি হলো- টাইটেলে  শীতালং শাহের ‘সুয়া উড়িলো উড়িলো’ গানের সাথে নাচ। হাওরের প্রতিটি দৃশ্য অসাধারণ সৃন্দর হয়ে এসেছে। আরেকটা সুন্দর দৃশ্য হলো কমলা ছাদের রেলিংয়ের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে আর শাহ আলমের ঘরের জানালায় ছায়া পড়েছে।

কমলা ও ফুলরাণীর সাথে হুমায়ুন আহমেদ

এবার গান নিয়ে দুই এক কথা বলা যাক। হুমায়ুনের অন্য চলচ্চিত্রের মতো চমৎকার চারটি গান আছে। এরমধ্যে অসাধারণ হলো সুয়া উড়িলো উড়িলো। এই গানটি গেয়েছেন ফজলুর রহমান বাবু ও শফি মন্ডল। জীবের জীবনের বৈচিত্র্য সব পর্বের বর্ণনা আছে এই গানে। চলচ্চিত্রর শেষে প্রান্তির কন্ঠে গানটি কমলার অপূর্ণ মানব জীবনকে প্রকাশ করে।এছাড়া অতিপরিচিত ‘যমুনার জল দেখত কালো’র সাথে আছে ‘ভাইসব সাবান কিনা দিলা না’সহ আরেকটি গান। আবহ সংগীত কিছু দৃশ্যে খুব চড়া হয়ে গেছে। অভিনয় নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নাই। হুমায়ুনের গল্প ও চিত্রনাট্য সব সময় নিরাসক্ত একটি ভঙ্গি পছন্দ করে। সে মোতাবেক চরিত্রগুলো থেকে কাজ আদায় করে নেন। এটিও ব্যতিক্রম নয়। তারিক আনাম খান, শামীমা নাজনীন, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের সাথে ছোট্ট প্রাপ্তির অভিনয়ও চমৎকার। তবে, কমলার অভিব্যক্তির দিকে আরেকটু মনোযোগ দিলে ভালো হতো।

হুমায়ুন আহমেদের খুব কম চলচ্চিত্রই আনন্দের দৃশ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। ঘেঁটুপুত্র কমলাও তার ব্যতিক্রম নয়। গাঢ় বিষাদ ছড়িয়ে যায়। হুমায়ুন তার নিজের প্রশ্নগুলোরও জবাব দেন না। আমাদের সামনে মালা গেঁথে রেখে যান। নানা প্রশ্ন আছে। যেমন শিল্পের রূপ কি হবে? এর সাথে মানুষের বিকাশ না বিকৃতির কি সম্পর্ক? শিশুরা ফুলের মতো পবিত্র না অন্যকিছু?

ঘেঁটুপুত্র কমলায় একটি সর্তকবাণী আছে। এই চলচ্চিত্র দেখার সময় দর্শকরা যেন শিশুদের নিয়ে না  আসেন। সর্তকবাণী নিয়া অনেকে বিরূপ কথা বলছেন। আমি এই সর্তকবাণীর সাথে একমত। আমার অভিজ্ঞতা জানায়- অনেক ছেলেরই শৈশব থেকে মেয়েদের সাজের প্রতি আকর্ষন থাকে। আবার ছোটরা অনুকরণপ্রিয়। এই সিনেমা যে বাচ্চা দেখবে- সেতো কমলার যন্ত্রণা দেখবে না। মুখে রং-চং মেখে বোনের জামা পরে নাচার চেষ্টা করতে পারে। তার কাছে এটা মজার বিষয় হতে পারে। এটা যেমন বড়দের জন্য বিব্রতকর আবার তার বিকাশের জন্য ক্ষতিকর। এর মনোস্তাত্ত্বিক ছাপ পড়তে পারে। আর একটা মেয়ে যদি বাসায় গিয়ে এই সংলাপ দিতে শুরু করে- কমলা ছেলে না মেয়ে! এটা শুনতে কেমন লাগবে! এবং এই প্রশ্ন সে এমন কাউকে করতে পারে- যে লোক আসলেই ভালো না। এছাড়া যারা বলছেন এটি সমাকামীতা ছড়াবে। তাদের উদ্দেশ্যে বলি, শিশুকামীতা আর সমকামীতা এক নয়, তবে দুটোই বিকৃতি।

শিশুকামীতা শুধুমাত্র ঘেঁটুপুত্রে সীমাবদ্ধ নয়- এটা আমাদের জানা আছে। সেইসব প্রশ্নের উত্তর অন্বেষনই এই চলচ্চিত্রকে আলাদা পূর্ণতা দিবে। এইসব উত্তর কোনটাই শুষ্ক চিন্তার বিষয় নয়- আমাদের যাপনও বটে। সব শিশুই ভালো থাকুক।

রেটিং: ৩.৫/৫

>তথ্য সুত্র: মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন কাসেমপুরী, গাডুগান, বাংলা একাডেমী ফোকলোর সংকলন (খন্ড ৫৩), বাংলা একাডেমী, জুন ১৯৯২।

>ফটো: ইন্টারনেট

 

Comments

comments

21 thoughts on “ঘেঁটুপুত্রের বনবাস

  1. যদিও মুভিটা এখনো দেখা হয় নাই। তবে রিভিউটা দারুন হইছে। ফেসবুকে শেয়ার দিলাম।

      • আমার ডাকনাম সঠিক বানানে লিখেছেন দেখে খুশি হলাম।

        অফটপিক: আমি কিন্তু ‘ইচ্ছেশূন্য ব্লগ’ প্রায়ই ভিজিট করি..:)

  2. চমৎকার লিখেছেন সুজন। আপনার লেখার গাথুনী ভালো; পড়ে আরাম পাওয়া যায়।

    আর মুভি নিয়ে কি বলবো! ছাগুদের সাথে ফাইট করতে করতে জান যায় যায় অবস্থা 😛 হুমায়ুন আহমেদ থেকে সবসময় এক্সট্রাওর্ডিনারী কিছু চেয়েছিলাম – মুভিটা যদিও দেখা হয়নি – তবে মনে হচ্ছে এই মুভিটা কোন অর্ডিনারী না।

    ভালো থাকবেন।

    • বস ধন্যবাদ।
      তাদের নিয়া কথা কইয়া লাভ নাই। ঐদিকে ঘর পুইড়া যাইতেছে তারা ভাবে চোখ বন্ধ করলে প্রলয় বন্ধ হবে। যত সব রাবিশ।
      কাহিনীতে আরো অনেক সম্ভাবনা ছিলো- বাজেট ও বাংলাদেশ চিন্তা করে দেখতে হবে। অফটার অল কথিত আর্টফিল্মের মতো সারাক্ষণ ন্যাকা ন্যাকা দুঃখী দুঃখী ভাব ছিলো না। মজার অনেক জিনিস ছিলো। ভালো লাগবে।

      আপনিও ভালো থাকুন।

  3. Sujan, I have enjoyed your review. I also read your previous reviews. But this one is more insightful and penetrating than your other reviews. It indicates the writer in you is maturing and you are supassing yourself. Good luck!

    If you have time, I would request you to add a para exclusively on a comarative study with other films directed by Humayun Ahmed.

    Happy writing

    • আকাশ, তোমার মন্তব্য পেয়ে ভালো লাগল।

      তুলনামূলক কিছু বলার ইচ্ছা ছিলো…. কিন্তু স্মৃতি ও বিষয় মিলাইয়া বলা থেকে বিরত থেকেছি।
      দেখি সময় করে পুরা একটা পোষ্ট দেয়া যায় কিনা।

      ভালো থেকো। তোমার লেখালেখির কি খবর?

  4. ইভাবে সেই আধ্যাত্মিক ভাবের খবর চাপা পড়ে গেল। সময়ের সাথে এই অনৈতিক উদযাপন উঠে গেল। সেই প্রথার কদর্য রূপটিই হুমায়ুন আহমেদ তার গেঁটুপুত্র কমলায় তুলে এনেছেন। এই গানের আধ্যাত্মিক মহিমার কোন তুলনা যদি এই সিনেমায় আসত- তবে মানুষ গাঁটু গান সম্পর্কে আরেকটু জানতে পারত। এখন শুধুমাত্র এই ঐতিহ্যের খারাপ রূপটিই আমরা দেখলাম।…………ধর্মের চর্চা যখন ক্ষমতার পদনত হয়- তখন সেই ধর্মের কোন স্পিরিট থাকে না। ইমাম সাহেব যখন কমলাকে বেত দিয়ে মারেন- তখন তিনি আসলে নিজের ধর্মচর্চা ও জমিদারের অনাচারকেই আঘাত করেন। …… chobiti ami dekhi ni, dekhar ecchao jagche na. apnar mullayon chomatkar.

  5. খুব শীর্ঘই প্রেক্ষাগৃহে মুভিটা দেখবো। ছবিটা নিয়ে সবার কাছ থেকে বেশ ভালো রেসপন্স পাওয়া যাচ্ছে।
    আপনার পর্যালোচনা বরাবরের মতই দারুন লাগলো।

  6. কবি, আপনার রিভিউ মানেই আলাদা কিছু, নির্মোহ চোখে গভীর উপলব্ধির বয়ান। অনেক ভালো লাগল, তবে মুভিটা দেখার ইচ্ছে নেই। আমি শিশুদের ব্যাপারে খুবই স্পর্শকাতর হয়ে যাই, সহ্য করতে পারি না অনেক কিছুই। শুভেচ্ছা জানবেন প্রিয় কবি।

  7. অদ্ভুত রিভিউ লিখেছেন। আমার ছবিটি দেখা হয় নি। এজন্য ছবি নিয়ে কিছু বলতে পারছি না, শুধু এটুকু বলা যায়- টপিক হিসেবে ঘেঁটুপুত্র – খুব খারাপ নয়- অনেক কিছুই অনেকভাবেই দেখানোর আছে।
    ভালো থাকুন।

Comments are closed.