সিনেমা প্যালেসে পরাবাস্তব মুভি

সিনেমা প্যারাডেসো(Giuseppe Tornatore, ১৯৮৮) নামের ইতালিয়ান একখান মুভি আছে । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইতালিয়ান দ্বীপ সিসিলির বাগেরিয়ার কাহিনী। এই সিনেমায় আছে সিনেমা প্যারাডেসো নামক সিনেমা হল, প্রজেকটর চালানেওয়ালা আর সিনেমা পাগল এক বালকের গল্প। যে বালক পরবর্তিতে নামজাদা চিত্রনির্মাতা হয়ে উঠে। মুভি দর্শক আর বোদ্ধাদের যথেষ্ট আদর পেয়েছে এই মুভি।

সিনেমা প্যালেস 

হঠাৎ একদিন রিকশায় থাকা অবস্থায় এই সিনেমাটার কথা মনে পড়ছে। তখন চট্টগ্রামের পাবলিক লাইব্রেরী পার হয়ে হাজারি গলির দিকের চৌরাস্তা না পঞ্চরাস্তায় পড়ছি। সদরঘাটের নৌকা ভ্রমনের পর যাইতেছিলাম বন্ধুর বাসায়। বহাদ্দার হাটে দাওয়াত খাইতে। সামনে মূর্তমান সিনেমা প্যালেস। এখানে একটা মুভি দেখেছিলাম বছর পাচ-ছয় আগে। এর কয়েকদিন আগে চট্টগ্রামের আরাফাত আল মাসুদ একবার বলো ভালোবাসি মুভির রিভিউতে এই সিনেমা প্যালেস নিয়ে লিখেছিলেন, প্রেক্ষাগৃহের কথা একটু বলে নেই। চট্টগ্রামের অন্যতম প্রধান এই প্রেক্ষাগৃহখানি- এই সিনেমা প্যালেসের (চলচ্চিত্র প্রাসাদ!?) বেশিরভাগ দর্শক আসন ভেঙ্গেচুরে আছে, মাথার ওপর বেশিরভাগ বৈদ্যুতিক পাখা স্থির হয়ে আছে। নষ্ট। কিন্তু ঢালিউডে সবচে বিশাল বাজেটের কাজ ঈদুল ফিতরের উপলক্ষ্যেই মুক্তি পায়। কাজেই বাংলাদেশের মূলধারার চলচ্চিত্রের হাল চাল বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকতে নষ্ট পাখার নীচে ভাঙ্গা আসনই ভরসা! এই তো সেদিন গার্মেন্টস কন্যা  দেখতে গিয়েছিলাম গাবতলী টেকনিক্যালের এশিয়া হলে। ২৫ টাকা লেখা টিকেটের দাম চল্লিশ/পঞ্চাশ টাকা। অথচ চেয়ার ভেঙ্গে দর্শক মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আমার কপাল ভালো ছিলো!

মাসুদ এক আলাপে জানিয়ে ছিলেন, তিনি মূলধারার সিনেমা বানাতে যান। হয়তো হলের এই হাল দেখে তিনি ভাবতেও পারেন, এই হলে আমার সিনেমা দেখাবো না। যদি না দেখায় তো কই দেখাবেন- জটিল প্রশ্ন। আমাদের সরকার তো ইন্ডিয়া, পাকিস্থান, শ্রীলংকা বা নেপাল না যে- তারা সিনেমা হলের জন্য কিছু করবেন। আরেকখান কথা সিনেমা প্যারাডাসোতে নায়ক যখন তিরিশ বছর পর প্রজেকটর চালানেওয়ালার শেষকৃত্যে যোগ দিতে যান, ততদিনে সেই সিনেমা হলের জায়গা পার্কিং লট তৈয়ার হয়েছে। বাংলাদেশে অবশ্য শপিং মল হয়। আমি মুভি দেখছি এমন কয়েকটি হলের জায়গায় এখন শপিং মল। চট্টগ্রামের অলংকার, জলসা, নুপুর আর ঢাকার শ্যামলী।

ছোট বেলায় বাবার হাত ধরে যতবার শহরে যেতাম, ততবার এই হাজারিগলিতে আসতে হতো। অবাক হয়ে থাকিয়ে থাকতাম পোষ্টারের দিকে। স্বপ্নরাজ্য মনে হতো। এই হলে বাংলাদেশে আলোড়ন তোলা একখানা সিনেমা দেখেছিলাম। তাও আবার প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য তৈয়ার করা বাংলাদেশী মুভি। ফায়ার।

বাংলাদেশের স্বঘোষিত বয়স্কদের মুভি ফায়ার আমরা দুই বন্ধু ডিসিতে গরমে একাকার হয়ে দর্শন করলাম। মন্তব্য হলো, ওয়াক!!  এরই নাম বুঝি প্রাপ্তবয়স্কদের মুভি। কিছুটা পাপবোধ জাগে নাই, এমন না। কনফেশনও করে ছিলাম বোধহয়। কিছু বছর পর কবি নির্ঝর নৈঃশব্দ্য সেই পাপের বোঝা কমাইছে। তার মতে, ফায়ার দেখার অভিজ্ঞতা নাকি ইউনিক। সে বলতেছে, ফায়ার হলো স্যুরিয়েল মুভি। ফরাসী আগা-মাথাহীন মুভির মতো পুরষ্কার পাবার যোগ্য। কিভাবে?

ফায়ার মুভির প্রথম আধঘন্টার মধ্যে পাঁচ-ছয়টা গান ছিলো। এরমধ্যে একটায়- ভিলেন ঘরের মধ্যে খাটের উপরে কোন এক মহিলার সাথে গান গাচ্ছে আর নাচছে। আর উপর থেকে বৃষ্টি পড়ছে। ছাদ ভেদ করে ঘরের মধ্যে বৃষ্টির পানি আসলো কোত্থেকে? কি অসাধারণ আইডিয়া। একমাত্র পরাবাস্তবতা ছাড়া এটা সম্ভব না। এমনকি নায়িকার পোশাক, নায়কের হুংকার- কোনটাই বাস্তব না। সবই পরাবাস্তব।

cinema-paradisoসিনেমা প্যারাডেসো গ্রামীন পরিবেশের মুভি। ইতালিয়ান এই গ্রাম নতুন আধুনিক হয়ে উঠে নাই। মানুষে মানুষে সংঘবদ্ধতা তখনো জারি ছিলো। ধর্ম, গীর্জা, ফাদার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। গীর্জার পাদ্রী সিনেমা হলকে ধুপ দিয়ে পবিত্র করে যাচ্ছেন। চুমুর দৃশ্যগুলো সেন্সর করা হতো। কখনো কখনো দেখানে হলে গ্রামবাসীর মধ্যে চাঞ্চল্য তৈয়ার হতো। এই সিনেমার নায়ক সেই দৃশ্যগুলার জন্য ব্যাকুল ছিলো। বন্ধু আলফ্রেডো সেই দৃশ্যগুলো তার জন্য কোটাবন্দী করে রাখে। আমারও অবস্থা ফাদারের মতো! দুই একটা দৃশ্য না থাকলে কোন ক্ষতি ছিলো না। কিন্তু এই দেশের সিনেমার জন্য আনুষ্ঠানিক ফাদার’রা (যাদের উপর দেখভালের দায়িত্ব) কিছু করতে পারেন না। ফলে ‘ফায়ার’ কিছুই বাদ রাখে নাই। কিছুই কোটাবদ্ধ হয় নাই।

আরো চারটা ডিস্কসহ আমার গোত্রের এক ভদ্রলোক সিনেমা প্যারাডেসার ডিস্কখানা মেরে দিছেন। তার জন্য ভালোবাসার অভিশাপ। যে অভিশাপ দার্শনিক স্পিনোজাকে তার গ্রোত্রের লোকেরা দিয়েছিলো তেমন কঠিন কিসিমের কিছু না-

দিন ও রাতের অভিশাপ পড়ুক তার ওপর; অভিশপ্ত হোক সে নিদ্রা ও জাগরণে, ঘরে ও বাইরে। ঈশ্বর যেন আর কখনো তাকে ক্ষমা না করেন বা কাছে টেনে না নেন। এখন থেকে যেন ঈশ্বরের কোপানলে দগ্ধ হতে হয় তাকে…

যাক অনেক হইসে। এটা আমার মনের কথা না। আল্লাহ তার উপরে রহমত বর্ষণ করুন।  সে যেন আর কারো ডিস্ক মেরে না দেয়। আর আমাদের সরকারগুলো যেন সিনেমা আর সিনেমা হলের দিকে মনোযোগী হন। তাইলে হয়তো সিনেমা প্যালেসকে একদিন আরো চমৎকার কোনো অভিজ্ঞতার জন্য স্মরণ করব। বেচে থাকে সিনেমা প্যালেস। বেচে থাক বাংলাদেশী সিনেমা।

Comments

comments

2 thoughts on “সিনেমা প্যালেসে পরাবাস্তব মুভি

  1. বেচে থাকে সিনেমা প্যালেস।বেচে থাক বাংলাদেশী সিনেমা। – এইটাই সত্যি কথা। ইদানিং ভেবে চিন্তে দেখলাম, যে সমস্ত লোক সিনেমা হলের স্বল্পতা এবং দুরাবস্থার জন্য সিনেমাকে গালি দিচ্ছেন, বলছেন যে এ কারণে সিনেমার সংখ্যা কমে যাচ্ছে, তারা ক্ষেত্রবিশেষে অন্যায়ও করতেসেন। এই জায়গায়ও সত্যিকার অর্থে দায়ী হলো সরকার।
    গত দশকে যখন হঠাৎ করে সিনেমাতে দিক পরিবর্তন হল, গল্প এবং দৃশ্যায়নে যৌনতা এবং হিংস্রতা জায়গা করে নিল, তখন থেকেই সরকার নিরব ভূমিকা পালন করেছে। এই নিরবতা ভেংগে সরব হতে হতে এক দশক শেষ। দিক পরিবর্তনটা যদি তখন রুখে দেয়া যেতো তবে হয়তো সিনেমাহল গুলোর দুরাবস্থা হতো না, হলের জায়গায় শপিং মল দাড়াতো না।
    এখনো এই অবস্থার উন্নয়ন করা সম্ভব। এর জন্য হয়তো সরকারকে সিনেমাহল পর্যন্ত আসতে হবে না, সিনেমার কারখানাতেই উন্নতির মাধ্যমে সিনেমাহলের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে সরকার।
    পোস্ট ভালো লাগছে – চমৎকার 🙂

    • ধন্যবাদ দারাশিকো ভাই।

      সিনেমার এই দিক পরিবর্তনে কারো যেন কোন মাথা ব্যথা ছিলো না। একদল লোক এই নিয়া চিল্লাপাল্লা করল মানে এই নিয়া নানা ব্যবসাপাতিও করল। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হলো না। ফলে, কোন জিনিসের ঐতিহাসিক যে প্রগতি থাকে সেদিকে মোটেও গেলো না।

      চারদিকে শুধু সমালোচনার বন্যা। কলকাতার মেইন স্টিমের মুভিগুলা দেখেন, সেগুলার বেশিরভাগ হিন্দী বা তামিল থেকে মেরে দেয়া। অথচ প্রযুক্তি ও দেখানোর ব্যবস্থা কতো ভালো। ভালো ব্যবসাও করে।আবার সাথে সাথে শুকনো লংকা, অন্তহীন, মেমরিজ ইন মার্চ, আবহমানের মতো মুভি দাড়িয়ে গেলো। অথচ আমাদের এখানে একটা রীতি হয়ে দাড়িয়েছিলো সিনেমা হলের দেখানোর জন্য সিনেমা না বানানো।

Comments are closed.