এক.
ডোরা কাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়। কিন্তু এক বাঘ আরেক বাঘকে চিনতে কি ডোরাকাটা দাগের খবর নেয়? অথবা ডোরাকাটা দাগকে চিন-পরিচয়ের চিহৃ করতে বাঘ সম্প্রদায়ের মতামত নেওয়া হয় নাই। না নেওয়াকে দোষের কিছু বলা যায় না। প্রজাতিগত যোগাযোগের সমস্যা। আবার এই ধরণের একটা পরিচয়ের মধ্যে কাওরে আটকাইয়া ফেললে আমাদেরই লাভ। সমস্যা থাকে, যদি কোন কারণে একটা বাঘ পাওয়া যায় তার গায়ে ডোরা কাটা দাগ নাই? তখন কি হবে? দেখা গেল বাঘ সমাজ তারে ভ্রাতৃপ্রতিম ভালোবাসায় গ্রহন করতেছে কিন্তু মানুষ কয়, সে যে বাঘ তার কোন প্রমাণ নাই। এই রকম নানা কিছু হরহামেশা ঘটে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- গানের পরের লাইন গুলা। মানে আপনে মানুষ চিনবেন কেমনে? তার গায়ে তো কোন ঢোরাকাটা দাগ নাই অথবা তারে জন্তু [যেটাকে নানা জন কইছেন তাদের আত্মা নাই, এরা টিভি কম্পুটারের মতো কোন নিয়ম দ্বারা চালিত, অর্থ্যাৰ তার আউটপুট-ইনপুট আগাম অনুমান করা চলে। যেহেতু ঘোষণা দিছে মানুষ সাবালক] কইতে পারেন না। পারেন না মানে মানুষকে স্ট্যার্ন্ডাড একটা জায়গায় রাইখা বলছি। ধরুন, আপনে কাউকে বর্বর, অসভ্য বলে তার উপ্রে নানা জোর জবরদস্তি কারিগরি জ্ঞান মানে তারে আপনার জ্ঞানের বিষয় বানাইয়া- তাকে শাসন করছেন। এটা হলো অপনার বিদ্যার জোর বা গায়ের জোর। এই জোরের খাতিরে তার ডোরা কাটা দাগ খুইজা পাইছেন। তারপরও, কথা থাকে সেই জনগোষ্টী অথবা অন্য কোন অঞ্চলের মানুষ আপনার উপ্রে খেপতে পারে। তাইলে…..। তার কাছেও একটা স্ট্যার্ন্ডাড আছে। যেখানে আপনি মনুষ্য প্রজাতির মধ্যে আসল মাল না। খুশির খবর হইলো, একদল মানুষ এই কাল্পনিক ডোরাকাটা দাগ নিয়া খুশি। বাকবাকুম করতে পারলেই তারা খুশি।
দুই.
এন্তোনি হোপের প্রিজনার অব জেনডার কাহিনীখান এইরকম…. নায়ক রাসেনডেল ভিনদেশে বেড়াতে গিয়া পড়ে এক ফ্যাসাদে। কারণ সেই দেশের রাজা দেখতে হুবহু তার মতো। আবার সেই রাজার শত্রুর অভাব নাই। ঘরের শত্রু বিভীষণও আছে। তো, সেই রাজা মারাত্বক আহত হলে রাজার হয়ে প্রক্সি দিতে হয় রাসেনডেলকে। যাতে শত্রুপক্ষ ও জনগণ বুঝতে পারে রাজা বহাল তবিয়তে আছে। অল কোয়াইট অন দ্যা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট। এদের সাথে তারে সামাল দিতে হয় রাজার প্রেমিকারে। নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে সে প্রক্সি দেয়ার দায়িত্ব থেকে ছাড়া পায়। কিন্তু যা ঘটার তাতো ঘটে গেছে। ততদিনে সে রাজকুমারীরে মন-প্রাণ সপে দিসে। অন্যদিকে রাজকুমারীও শেষকালে জানল সে এতো দিন ভুল লোকের প্রেমে মজেছিলো। কিন্তু তার মন বলে, এটা ঠিক না। সে হয়তো রাজা ছিলো না, কিন্তু প্রেমিক হিসেবে রাজা নকল আর এই নায়কই আসল। প্রেমের মরা জলে ডুবে না। সেটা কেউ পরীক্ষা করছিলো কিনা কে জানে? এন্তোনি হোপকে এই উপন্যাসের দ্বিতীয় খন্ড লিখতে হয়েছিলো। সেটা আবার উপন্যাসের ভিলেনের নামে। রূপাট অব হেনেতযাউ। প্রেমের টানে রাসেনডেল রাণীর সাথে দেখা করতে আসে। সেখানে ভিলেনের হাতে নিহত হয়। যাই হয়…. রাণীর আদর্শিক ধারণাটাই পোক্ত হলো। আসল মানুষ না হোক আসল প্রেমিক তো পাওয়া গেল। কেউ কেউ এই তর্ক তুলতে পারেন, সে আসল প্রেমিক না সে আসল মানুষও না। কিন্তু আমাদের কি এতো আবেগী হইলে চলে।
তিন.
এন্তোনী হোপের কাহিনীখানে- যদিও আসল মানুষের বাতচিত না তারপরও ঘটনা ছিলো নামে নামে [বদন মুবারক] যমে টানে কিসিমের। কিন্তু লুই স্টিভেনসনের ডক্টর জেকিল এন্ড মিস্টার হাইড। অসাধারন এক উপন্যাস। ডক্টর জেকিল এমন এক ঔষুধ তৈয়ার করেন, যা তার ভালো ও মন্দ দুই গুনকে আলাদা করে ফেলে। সেখানে ডক্টর জেকিল হলেন সজ্জন আর মিস্টার হাইড বদের বদ। শেষ পযন্ত পরিণতি খারাপ। কারণ আর কিছু না…. মানুষের ভেতর বাইর যখন ফকফকা হয়ে যায়, করার কিছুই থাকে না। ডক্টর জেকিলের বিজ্ঞানের বদহজম। কারণ, আর কিছু না। সে তো মানুষের খারাপ দিকরে মানুষের বলেই গণ্য করে নাই। এটারে জ্যান্তব বইলা পশু-প্রজাতিরে অপমান করছে। কিন্তু এর বাইরে মানুষ বইলা যে জিনিস- তাতো এই ভালো মন্দের মিশেল। এই মিশেলটাকে কেন জানি আমরা সহ্য করতে পারি না। তাই, কারো গায়ে ভালো মন্দ নিশানা না দিলে আমরা শান্তিও পাই না। তাই বলি ফেরেশতার মতো অথবা পশুর অধম। কিন্তু এই উত্তম-অধমের বয়ানের শেষ কই। এটা চলতেই থাকে।
চার.
এই অভিজ্ঞতার কথা অনেকের কাছে শুনা যায়। তিনি এক বুজুর্গের দেখা পাইছেন। আমি শুনছি আমিন ভাই, বদিউর রহমান স্যার আর কার কাছে যেন। আমিন ভাইয়েরটা তার বাপের বলা ঘটনা। বুজুর্গ ব্যক্তি তার সাবজেক্ট ব্যক্তির তার চোখে হাত বুলাইয়া বললেন, দেখ দুনিয়ার মানুষগুলা কেমন। এইগুলা বাইরে যা, ভেতরে তার বিপরীত। তিনি দেখলেন, কিছু মানুষ হায়েনা, কিছু মানুষ বাঘ ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলো হলো মৌল প্রবৃত্তির বিষয়। ধরেন বাঘের কাজ শিকার ধরা। সে তা করে। এইটা সেই তরিকা, এর বাইরে সে কিছুই জানতে চায় না বুঝতে চায় না। সেইটা বুজুর্গদের লাইন, সে লাইনে গিয়া আপনার আমার কাজ কি। দেখেন না তারা হালে নাই। বেহাল। সে লাইনে হয়তো আসল-নকল, ইনসান-উল-কায়েম চেনা যায়। কিন্তু সেই পথ তো আর সবার জন্য উম্মুক্ত না। যদি আমরা সাধারণ মানুষ সেটা করতে যাই, দেখা যায় বেহেশত-দোজখের সনদ বিতরণ করতেছি। তাই এর চেয়ে ঢের ভালো একাট্টা ভালো-মন্দের, আসল-নকলের ফয়সালায় না যাওয়া। কিন্তু কে শোনে কার কথা। যেহেতু আপনি মনুষ্য প্রজাতির অর্ন্তগত, তাই আপন স্বভাবের গুনে নিজেকে অতিক্রম করার চেষ্টা করবেন।
পাঁচ.
ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করার পরও এই বিশ্বাস জারি আছে, থাকবেও। আসল ওসামা মরে নাই। যেটা সাদ্দামের বেলায়ও হয়েছে। যদিও দুই ঘটনার যোগসুত্র আছে কিন্তু সেগুলা গুণগতভাবে আলাদা। এই না মরাটা কি শরীরি কিছু। প্রাথমিকভাবে হয়তো সেটায় মনে হয়। না, আরো গুরুতর জায়গা থেকে। যেটারে আধুনিক জ্ঞানকান্ড বলবে প্রতীকি গুরুত্ব। আস্থার জায়গা, ঈমানের জায়গা। যে তারে ভালোবাসে তার কাছে সে এমনি এমনি মরবে না। তারে মারতে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হবে। প্রেমের মরার আসলে মরণ নাই। সে মরে না তার জলে ডুবা-না ডুবায় কি আসা যায়। সেই মরণ অন্যখানে।
ছয়.
আসল মানুষ কি? কিছুই না। ঐতিহাসিক মানুষের এক ধরণের আকুতি। এই আকুতি ক্ষণস্থায়ী মানুষকে মানুষেরই কোন পরম ভাবের সাথে সংযুক্ত করা। সৌন্দর্যের ধারণাও বটে। সত্যম-শিবম-সুন্দরম। তিনই থাকে। এই পরম ভাবের কল্পনা মানুষের মধ্যে জ্বলে উঠে মানুষেরই সম্ভাবনা হয়ে। তাই কে কোন ভাবে কোন পরিস্থিতিতে কি খুজছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। তাই আসল মানুষ খুজতে গেলে পিতৃভাব, মাতৃভাব.. নির্ভর করে সেই ব্যক্তি মানুষের উপরে সে আসলে কি খুজছে। সুতরাং, এই আসল মানুষের কথা বলতে গিয়া পরিপূর্ণ সম্বন্বয়ী সম্পূর্ণ কোন মানুষের কথা হয়তো বলি নাই। কারণ মুহুর্তগুলো অনেকসময় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। কিন্তু সে রকম মানুষের ধারণা আদর্শিক হতে পারে বাস্তব না। কিন্তু চেতনার বাস্তবতায় সে সর্বদায় নতুন নতুন ফুল ফুটিয়ে চলে। তাই আমরা যখন শুরু করি তখন সম্পূর্ণতার ধারণা থেকে করি, তারপর নিজের অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে সে নির্দিষ্ঠ রূপ লাভ করে। আবার সে সম্পূর্ণতার ধারণায় উপস্থিত হয়। এটা পূর্ণাঙ্গ কিছুকে খন্ড করে দেখা না, তার গায়ে আলো ফেলে যতটুকু বুঝা যায় আর কি। কিন্তু পূর্ণাঙ্গভাবে ভাবনার ভেতর দিয়ে ব্যক্তির ঐতিহাসিকতা পেছনে ফেলে দেয়। তখন আসল মানুষ তারে পথ দেখায়।
মানুষ কি তার দেখা পায়। একদা ইমানুয়েল কান্ট অধিবিদ্যা নিয়ে সংশয় জানিয়েছিলেন। তিনি বলেন আমরা বস্তুর অবভাসিত বা বাইরের রূপটাই জানি কিন্তু এর ভেতর জগতটা জানি না। প্রথমটা ফেনোমেনা আর দ্বিতীয়টা নোমেনা। তিনি মানুষের ক্ষমতা-অক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। ভালো কথা। কিন্তু মানুষ মানে কাঠামোবদ্ধ না। তার মধ্যে পর্যবেক্ষক হওয়ার মতো গুন আছে। কান্ট নিজেই নোমেনাকে না দেখে তার কথা বলছেন। এই বলাবলির মধ্য দিয়ে একপ্রকার দেখাদেখি সেরে যায়।
সাত.
প্রতিবছর রাসেনডেলের কবরে ফুল ফোটে। তার কবরে ফুল অনাদিকাল পর্যন্ত কেউ না কেউ দিয়ে যাবে। হয়তো লোকে তার নাম জানবে না- কিন্তু সেতো ছিলো নকলের ভিড়ে আসলি প্রেমিক। আর ডক্টর জেকিল এন্ড মিস্টার হাইডে ভালো-মন্দরে আলাদা করতে গিয়া প্রকৃত মানুষটাই মিলিয়ে যায়। তারপরও কে যেন থেকে গেল। কি যেন থেকে গেল। সেখানে কিছুই আলাদা নাই- অথচ সেই আলাদা করতে চেয়েছিলো। এক আবার অনেক। লাদেনের কোন কবর নাই- সুতরাং, বিমূর্ত হইয়া তার ভক্তদের মাঝে ব্যক্তির ব্যক্তি হয়ে উঠার মধ্য দিয়ে কারো কারো ইতিহাসে সে আসল মানুষ হয়ে থাকবে। সেটা কাল্পনিক অথবা বাস্তব হোক- তাতে কোন সমস্যা নাই। কিন্তু মানুষ তার আপন ইতিহাস দিয়ে বুঝে তার আসল মানুষটা কোন কিসিমের হবে। সেটা দিয়ে সে অনেক কিছু ফারাক করে।
রশিদ উদ্দিনের একটা গানের লাইন আছে না, ‘মানুষের ভেতরে মানুষ, তার ভেতরে বিরাজমান’। মানুষের মধ্যে মানুষটা আসল। যেটাকে আমরা সত্যিকারের মানুষ বলি তার সাথে কি কখনো দেখা হয়। ব্যাপারটা এইভাবে দেখেন- আপনি যখন নিজেরে বিশ্লেষণ করতে যান একটা বিষয় নিশ্চয় চোখে পড়ে আপনি ভাবতেছেন আচ্ছা, আমি কি এমন? না, আমি এমন না। আপনি আমাকে যেভাবে দেখেন, আমি সেইভাবে থাকবে চাই না। আপনি আমারে যা করতে দেখেন, আমি আসলে তা করতে চাই না। আসলে এই আমি আসল আমি না। তাহলে সেই আসল মানুষটা আমার ভেতরও থাকতে পারে। সেটা কে? হয়তো কেউ জানে না। অথবা সাহস করে এই কথা বলে আনন্দ লাভ করতে পারি, ‘সবাই জানে কিন্তু কেউ মুখ খোলে না। বৃথা রহস্য ভেঙ্গে কি লাভ’।
অনেক ভালো লাগল কবি। দর্শন এবং রিভিউ। অনেক ধন্যবাদ।
আমিন ভাই, কতদিন পর আপনাকে পেলাম। ইদানিং মনে হয় খুব ব্যস্ত। আপনাকে এই লেখায় পেয়ে খুবই ভালো লাগছে।
শুভ কামনা।
তেমন ব্যস্ত না সুজন ভাই। কোনো কিছুতেই মন বসাতে পারছি না। শিক্ষা জীবন শেষ, ভালো একটা চাকুরি খুঁজছি। খুব ইচ্ছে আছে, আপনাদের সাথে থেকে ইতিহাস, সাহিত্য, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও দর্শন নিয়ে পড়াশুনা করার।
আপনিও অনেক ভালো থাকবেন। পূর্বের লেখাগুলো এক এক করে পড়ে ফেলব ইনশাল্লাহ 🙂
ইনশাল্লাহ ভালো চাকুরি হয়ে যাবে। তখন কিন্তু আমাদের অনেক অনেক আব্দার মিটাতে হবে।
মন দিয়ে পড়াশুনা করেন।
+++
ধন্যবাদ Shikdar Waliuzzaman.
+++
ধন্যবাদ মাসুদ জাকারিয়া।
ধন্যবাদ।
আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।
‘বাঘের কাজ শিকার ধরা’—-এই ভুল ধরে লিখা হলে প্রশ্ন আছে আরো অনেক
ধন্যবাদ ফায়হাম,
বাঘের কাজ শিকার ধরা…. সে আসলে যা করে, তা-ই তার কাজ। নিশ্চয়।
যে প্রসঙ্গে শিকার ধরার কথা বলছি, সেখানে যখন কোন মানুষকে বাঘের মুখোশ পরিয়ে চিন্তা করা হয়- তখন সে মানুষের মধ্যে এই শিকার ধরা-ধরিকেই আরোপ করা হয়। যেটা আমরা করি, যেমন বলি- পাশবিক, পশুপ্রবৃত্তি, পশুর অধম ইত্যাদি ইত্যাদি। জাস্ট এই বিষয়টাকে উল্লেখ করা হয়েছে।
যদি প্রশ্ন থাকে, আমাদের মধ্যে অনেক কথা হতে পারে। নিজেদের বুঝাপড়ার জন্য কথা বললে আমারও সুবিধা।
আপনার রেসপন্স ভালো লাগল। শুভ কামনা।