একটা নদী।
দূর কোন পর্বত থেকে নেমে আসে। তারপর কতো কতো পথ পাড়ি দেয়। কতো জনপদ। কতো বিরাণ ভূমি। কতো শূনতা-কতো বিপুলা তার অপেক্ষায় থাকে। একটা নদী একটা বৃহৎ স্বপ্ন। একটা নদী কতো কতো গন্তব্য তৈয়ার করে। সেই হদিস নদী নিজেও রাখে না। গন্তব্যের হদিস রাখে পথের পথিক। পথিক ছাড়া কার দবকার পথের দিশা। অথবা পথিকই ঠিক করে পথ।
মাঝি, আর কতো দূর?
এই নিয়ে কমপক্ষে সাতবার এই প্রশ্নটা করলাম। মাঝি ফিরেও তাকালো না। আপন মনে নৌকার বৈঠা বাইছে। এমন নদীর কথা কখনো শুনি নাই। কূল কিনারার কোন নির্দেশ নাই। আমি যে কোন একটা ঘাট থেকে নৌকায় চড়েছে সেটাই যেন অবিশ্বাস্য। চলছি তো চলছি। এ যেন অকূল দরিয়া।
মাথার উপর দ্বি প্রহরের সূর্য্য। তেজ টের পাওয়া যায় না। নদীর জল ঠিকরে আলো পড়ে চোখে। চোখ ধাঁধিয়ে আসে। ছৈয়ের ভেতর শুয়ে শুয়ে চোখ ধাঁধানো জলের নকশা দেখতে দেখতে ফেলে আসা সময়ের কথা ভাবি। সেই সময় পাখির মতো উড়ে গেছে। আর কখনো ফিরবে না বলে। হায়.. জগতের সবকিছু কতো তুচ্ছ।
মাঝি এটা কী নদী?
ভব নদী।
এই নদীর নাম শুনি নাই। কোত্থকে আসছে?
এই নদী আসে না। সে আগে থেকে থাকে।
আমি অবাক হই। এই ধারার নদী আর মাঝির কথা আগে কখনো শুনি নাই।
এই নদী কোন সমুদ্দুরে মিলেছে?
জীবন সমুদ্দুরে…..
জীবন সমুদ্দুর???
মহর্ষি’র দেখা পাওয়া মানবের শতজনমের ভাগ্য। তিনি সত্যের দীক্ষা দেন। তিনি মনের মধ্যে অশান্তির বীজ বেড়ে উঠা সব প্রশ্নের জবাব দেন। তার কাছে গেলে অনন্ত পিপাসার নিবারণ হয়।
তার সাথে দেখা হয়েছিলো বিন্ধ্যা পর্বতে।
মহর্ষি আমি… আমি আপনাকে কতবছর ধরে কতো জায়গায় খুঁজেছি। যেখানে আপনার কথা শুনেছি ছুটে গিয়েছি। গিয়ে দেখি আপনি সেখানে নাই। আমি জানতাম একদিন আপনার সাথে আমার দেখা হবে। আজ আমার মানব জনম সার্থক হলো।
আমাকে তোমার কী প্রয়োজন?
জীবনের রহস্য জানতে চাই?
কেন?
এই জীবন এই নশ্বরতা সবকিছু আমার কাছে তুচ্ছ মনে হয়। আমাকে প্রতিনিয়ত ক্লান্ত করে। মনে হয় এই বেঁচে থাকার কোন অর্থ নাই। আমি এর মাঝে শান্তি খুঁজে পাই নাই। আমি অনন্ত-অসীম-নিখিলকে জানতে চাই।
তুমি কি নিশ্চিত, তোমার ভাবনা সঠিক?
মহর্ষি, আমি জানি না। সংশয়, দ্বিধার অশান্তি আমার সমগ্র চেতনা আচ্ছন্ন করেছে। আমি শুধু তার থেকে পরিত্রাণ চাই। আমি শুনেছি আপনি মহাজীবনের দীক্ষা শিক্ষা দেন। যে আপনার শিক্ষা ধারণ করতে পারে, তার জীবন হতে সংশয়-দ্বিধা কেটে যায়। আপনি আমাকে শিষ্য করে নিন।
সেই জ্যোতিময় পুরুষ। কি প্রশান্ত চেহারা। টলটলে দুটো চোখ। স্বচ্ছ সরোবর যেন। সেই সরোবরে কোন ছায়া পড়ে না। প্রগাঢ় দৃষ্টিতে আমার চোখে চোখ রাখলেন। সেই স্বচ্ছ দুটি চোখে চোখ রেখে আমার সমগ্র সত্ত্বা কেপে উঠল।
আমি কাউকে শিষ্য বানাই না!
বেদনায় মনটা যেন ভেঙে গেল। আমি কিছু বলতে পারি না। একি শুনছি। তবে কি এতো এতো পথ পাড়ি দেয়া বৃথা হলো। আমার অশান্তি কি কখনো গুছবে না।
মহর্ষি দয়া রাখুন।
আমার কাছে কিছু নাই। তোমার পথ তোমাকেই খুঁজে নিতে হবে। আমিও সেই মহাজীবনের খোঁজে আছি। সে আছে আর যায়। তারে না যায় ছোঁয়া- না যায় ধরা। কিন্তু তার মধ্যেই থাকতে হয়।
আমি তার কথা বুঝতে পারি না।
তুমি তোমার খাসলতকে অনুসরণ করো। তার স্বাদ আস্বাদ করো। বস্তুকে যদি শুধুমাতো বস্তু ভাবের মধ্য দিয়ে দেখো তবে, জানা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ভাব একলা কিছু নয়, সে বস্তুকে ধারণ করে। এই নশ্বরতাকে অশান্তির বীজ ভেবো না। তারও একটা ঠিকানা আছে, নিয়তি আছে। যদি বুঝতে পারো, ভাবের সেই বোঝা বইতে পারো তবে ভব নদীর দেখা পাবে। সেই তোমাকে তোমার আপন ঘাটে নিয়ে যাবে। মনে রেখো জ্ঞান অর্জন আর বুঝতে পারা এক জিনিস না।
…. আর এই দুনিয়ায় কোন কিছুই তুচ্ছ না। কোন কিছুকে তুচ্ছ জ্ঞান করার মধ্যে কোন মহত্ত্ব নাই।
আমি তার কাছ থেকে দোয়া নিয়ে পথে নামি।
আমার চিন্তার সুর কেটে যায়। এই কি তবে সেই ভব নদী। আমি কখনো ভাবি নাই- এই নদী ধরণীর উপরে বেয়ে চলা বস্তু নদী। তবে মহর্ষি কি এই নশ্বরতার মধ্যেই জীবনের হদিস দিলেন। এইখানেই কি অনন্ত-অসীম-নিখিলকে পাওয়া যায়।
মাঝি আর কতোদূর?
আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমাইয়া লন। ঘাটে আপনারে নামাইয়া দিবো। আমি ঘাটের অপেক্ষায় থাকি। এই কি সেই আরাধ্য ভব নদীর ঘাট।
…. চমৎকার একখানা বাগান। এটাই কি নন্দন কানন। বাসন্তী বাতাসে ফুলের সুবাস। অনতিদূরে কিছু মানুষের জটলা দেখা যাচ্ছে। শুনতে পেলাম কে যেন বলছে, সে এসে গেছে।
কে?
আমি সেই জাটলার দিকে এগিয়ে যাই। মাথা উচু করে দেখার চেষ্টা করি, কে এসেছে। একজন চমৎকার যুবাপুরুষকে ঘিরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। স্মিত হাসি মাখা কোমল কান্তি মুখ। কেউ কিছু বলছে না। মনে হয় নিরবতায় এইখানকার ধর্ম। সবাই আমাকে পথ করে দিলো। আমি তার কাছে এগিয়ে যায়।
আমার তর সইছিল না।
বললাম, আপনি কে?
কে যেন বলে উঠল, চুপ চুপ।
আমি সেই কন্ঠস্বরকে অগ্রাহ্য করে আবার বলি, আপনি কে?
সবাই একই সাথে বলে, চুপ চুপ চুপ।
সে হাসি মুখে তাকিয়ে রইল, নিরত্তর।
আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, কে আপনি?
তিনি বললেন, আমি কেউ না।
চারপাশ থেকে অদৃশ্য কেউ একটানা ফিসফিস করে বলছে, আমি কেউ না, আমি কেউ না, আমি ..।
আমি ভয় পেয়ে বললাম, মাফ করুন, আমি বুঝি নাই।
তিনি বললেন, তুমি কে?
কে যেন আবার ফিসফিসিয়ে বলল, বল, আমি কেউ না।
আমি বলি, ‘আমি জানি না, আমি কিচ্ছু জানি না’।
তিনি বলনে, আমি’র কোন অর্থ না। আমিতে কোন কিছুর প্রতিস্থাপন হয় না।
দেখলাম, উপস্থিত সবার চেহারা আমার মতো হয়ে গেছে। আমি ভয় পেয়ে পালাতে গিয়ে দেখি, মাটি থেকে পা সরছে না। অদৃশ্য কিছুতে আটকে গেছে। আমি সর্বশক্তিতে পা তোলার চেষ্টা করলাম। পালাতে চাইলাম।
সে আবার প্রশ্ন করল, তুমি কে?
আমি বললাম, আমিই তুমি।
তিনি অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলেন, ভক্তিই সব নয়। প্রশ্নও করতে হয়।
তারপর বাগানের দৃশ্য পাল্টে গেল। সেই যুবাপুরুষ কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এই মনোরম বাগানে আমি একা। সেই বাসন্তী সুবাস। কোন ফিসফিসানি নাই। একটা পাখি ডাকছিল। সামনে শান্ত জলে টলমল সরোবর। সরোবরে মৃদৃ গরম জলে হাত দিয়ে দেহের শীতলতা টের পাই। হাত মুখ ধুয়ে নিই। একি জলে কোন প্রতিবিম্ব নাই..
মাঝি, আর কতো দূর?
মাঝির মুখে যেন অস্পষ্ট হাসি খেলে গেল।
আমি ঠিক দেখেছি তো! এই যাত্রায় এই প্রথম তার মুখে কোন ভাব দেখা গেল।
আমি বললাম, তুমি কে?
মাঝি চুপ করে রইল। আমি ভয়ে ভয়ে জলের কাছাকাছি মুখ নামিয়ে আনলাম। না ঠিক আছে। এই তো জলের স্রোতে আমারই প্রতিবিম্ব। আমার চলমান প্রতিবিম্বের মাঝে খেলা করে ছোট ছোট মাছ। আহা কি কোমল তাদের চলন। আমি আবার মাঝির দিকে তাকালাম। তার মুখে সেই রহস্যময় হাসি লেগে আছে।
মাঝি বলল, আপনার রব কে?
আমি বললাম, আল্লাহ!!
আল্লার নাম নেন, দরিয়ায় তুফান আইবো।
কি অদ্ভুত কথা। কোথাও মেঘের চিহ্ন নাই। রোদে ঝলমল চারদিক। মাঝিকে আমি অবিশ্বাস করি না। হ্যাঁ, তুফান আসবে। অনেক বড়ো তুফান। সব.. সবকিছু ভাসিয়ে নেবে।
মাঝির দিকে তাকালাম। সে ভাবলেশহীন মুখে তার কাজ করে যাচ্ছে। পাল গুটিয়ে নিলো। আস্তে আস্তে রোদ উধাও হয়ে তার জায়গা ঠাঁই নিলো কালো মেঘ। চারদিকে বেজায় অন্ধকার। তুমুল বাতাস। নদীর শান্ত পানি সমুদ্দুরের বিশালের ঢেউয়ের মতো নৌকার দিকে এগিয়ে আসছে। কি তার তর্জন গর্জন। ঢেউয়ের আঘাতে নৌকাটা ভীষণভাবে এইদিক ওদিক করছে। শক্ত করে নৌকার কিনারা ধরে আছি।
মাঝি আবার বলে, রবের নাম নেন।
আমরা সেই ঝড়ের কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে যাই।
সে ভীষণ ঝড়ের কোন বর্ণনা নাই। শুধু আল্লাহকে ডাকছি…
চমৎকার একখানা বাগান। নন্দন কানন। বসন্তী বাতাসে ফুলের সুবাস। কিছু মানুষের জটলা দেখা যাচ্ছে। শুনতে পেলাম কে যেন বলছে, সে এসে গেছে। একজন চমৎকার যুবাপুরুষকে ঘিরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। স্মিত হাসি মাখা কোমল কান্তি মুখ। কেউ কিছু বলছে না। নীরবতায় এইখানকার ধর্ম। আমি তার হাত ধরলাম। না আমরা কেউ কারো হাত ধরিনি। সে বাগানে কেউ ছিলো না। একা একা সে শীতল বাগানে ঘুরলাম। জন-মানবহীন এ স্থান আমার আর ভালো লাগে না। আমি সেই বাগানের গাছ কেটে একখানা নৌকা তৈয়ার করি। এরপর নদীর খোঁজে বের হই। সেই নদীটা পাড়ি দিতে হবে…।
মাঝি, এটা কি নদী?
আমি লোকটির দিকে তাকালাম।
মানুষটা খুবই অস্থির। কথা বলার সাথে সাথে হাত-পা ছুড়ছে। তার বোধহয় খুব তাড়া। বললাম, ভব নদী।
আমারে পাড় করতে কতো নিবা?
আপনার কাছে দেবার মতো কিছু থাকলে দেবেন, নয়তো বিনা পয়সায় পার করাইয়া দেবো।
লোকটার ভেতর লোভ জেগে উঠল। ভাবছে বিনা ভাড়ায় পার হওয়ার সুযোগ পাওয়া গেলো।
আমি নৌকা ছাড়লাম।
মাঝি, আর কতো দূর?
লোকটা ঘুমের ঘোরে প্রশ্ন করছে…
>গল্পটির অনুপ্রেরণা জার্মান ঔপন্যাসিক হারমান হেসের উপন্যাস সিদ্ধার্থ।
জীবন সমুদ্রের ভব নদী পড়ে বেশ ভাল লাগলো। নদীর একটি ওয়েবসাইট http://www.nodimatrik.com ভিজিটের আমন্ত্রণ রইল। শুভ ব্লগিং।
ওয়েবসাইটটা দেখলাম। চমৎকার কাজ হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে গিয়ে বাংলাদেশের নদীর যা অবস্থা দেখি চোখে জল এসে যায়। এমন সাইট নদী নিয়ে কাজ করার ভালো প্লাটফর্ম হতে পারে। শুভ কামনা।