জোছনা আমার বোন

এক.

আমাদের জন্ম আষাঢ়ী পূর্ণীমায়।

আমার মা স্বপ্নে দেখলেন, তিনি ঘরের দাওয়ায় বসে আছেন। তার এক কোলে সূর্য আর অন্য কোল খালি। পূর্ণ চাঁদ ঝুলে আছে ঠিক তার মাথার ওপর।

মা বললেন, বাছা তুইও আমার কোলে আয়।

আকাশের চাঁদ আকাশে আর রইল না। সাথে সাথে নেমে এলো তার কোলে।

এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিলেন আমার দাদীমা। বুড়ি আবার এইসবের ওস্তাদ। লোকে তার কাছে নানান তদবিরে আসতেন।

তিনি বললেন, বউ তোর যমজ বাচ্চা হবে। সূর্য হলো ছেলে, চাঁদ হলো মেয়ে। এরা আমাদের ঘর আলো করে রাখবে। শুভ লক্ষণ। মা এমন ভাব করলেন, এ এমন আর কি? আমিও বুঝেছি। আমার দাদীমা নিজের বুজর্গি জাহির করলেন পাড়া প্রতিবেশীর কাছে। নাম ঠিক করা হল।

ছেলের নাম হবে সুরুজ আর মেয়ের নাম জোছনা। আমার বাড়ি পালানো স্বভাবের বাবা ঘরে থিতু হলেন। বউয়ের যত্ন-আত্তিতে মনোযোগ দিলেন। তিনি সুরুজ আর জোছনাকে নিয়ে গান বাঁধলেন। সময়ে অসময়ে বউকে গান শুনাতেন। মা খুবই লজ্জা পেতেন। আবার আনন্দে মুখ ঝলমল করত। মা ভালো গান জানতেন। বাবা নাছোড় বান্দা। তাকে গান গাইয়ে ছাড়তেন। আহ্, কি মধুর দিন ছিলো মা’র জীবনে। এতো আনন্দ অভাবের সংসারে আগে কখনো আসে নি।

একটানা তিনদিনের বৃষ্টি। চারদিকে থৈ থৈ কাদা-পানি। বৃষ্টির পানি ঠেলে বাবা গেলেন ধাই ডাকতে। ধাই নিয়ে ফিরতে ফিরতে বৃষ্টি থেমে গেলো। ভরা চাঁদের আলোয় দুনিয়া ঝলমল করছে। কি চমৎকার জোছনা ফুটেছে। বাবা অভিভূত হয়ে হাঁটু সমান পানিতে দাঁড়িয়ে রইলেন। পরক্ষণে বাড়ির কথা মনে পড়ল। বারান্দায় পা দিতে না দিতে আমার কান্না শুনতে পেলেন। অন্য শিশুটির কান্না শোনার আশায় কান পেতে রইলেন। এবার জোছনার নিজেরে জানান দেবে।

দুই.

আমার নাম সুরুজ। আমার আর কোনো ভাই-বোন নাই। আমার বাবা কোনো দূরদেশে চলে গেছে কেউ জানে না। হঠাৎ হঠাৎ আমরা তার খবর পেতাম। এ হাটে ও হাটে তাকে দেখা যেত। আর, আমার মা। তিনি অদ্ভূত ঘোরের ভেতর জীবনপাত কাটিয়ে গেলেন। অদৃশ্য মেয়েটা ছিল তার চোখের মণি, আদরের একমাত্র হক্বদার। তিনি সারাক্ষণ জোছনাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন।

হয়ত বলতেন, সুরুজ তুই জোছনার সাথে খেলা করো, আমি তরকারিটা দেখে আসি।

আবার হয়ত বা কখনো জোছনাকে ঘুম পাড়িয়ে, আমাকে বললেন, এইখানে বসে থাক। আমি গোসল করে আসি। খেয়াল রাখিস, কখন আবার মেয়েটার ঘুম ভাঙ্গে। আমি মাঝে মাঝে বিভ্রান্ত হতাম। জোছনা শিশুটিকে দেখতে পেতাম যেন!

নানান ধরনের চিকিৎসা করা হল। রাজ্যের বদ্যি-কবিরাজ ফেল। একসময় আমার দাদার বাড়ির লোকেরা মাকে তার বাপের বাড়ি রেখে আসল। আমি রইলাম দাদীমার কাছে। তিনি আফসোস করতেন, ছেলে ফিরলে আরেকটা বিয়ে দিতেন। সবই কপাল, ছেলেটাও মাথা খারাপ।

শুনেছি মা সারাক্ষণ জোছনাকে খুঁজতেন। মার শেষ সময়ে আমি ছিলাম শিয়রে।

তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলছেন, আমি মরে গেলে জোছনাকে কে দেখবে?

নানীও কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আমরা আছি। তুই শান্ত হ। একসময় মার শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেল।

নানী আমাকে বললেন, সুরুজ তোর মাকে পানি খাওয়া।

মা বুঝি এতোক্ষণে আমাকে চিনতে পারলেন। দুর্বলভাবে হাসলেন যেন। আমি তার হাত ধরে রেখেছিলাম। তিনি আমাকে আরো শক্ত করে ধরলেন।

মা অনেক কষ্টে বললেন, তোর বোনকে দেখে রাখিস। আমি বললাম, রাখব। মা আমার হাতে শেষবারের মতো পানি পান করলেন। মা আমার, মুখে হাসি নিয়েই মারা গেলেন। তখনও মা আমাকে শক্ত করে ধরে আছেন।

তিন.

আমার জীবনের আট দশটা সাধারণ ঘটনার মতোই বাড়ি ছাড়ি। বাড়ি নামের শব্দটি আমার অনুভূতিতে কোনো আবেগীয় কামনা হিশেবে হাজির হয় নি। বরং, এমন চিন্তাকে অর্থহীন ধরে নিয়েছিলাম। কি আশ্চর্য, মাঝে মাঝে মনে হয় নানান দেশের নানান পথ ঘুরে কোনো এক স্বপ্নকে তাড়া করেছি যেন। বাড়ির কথা মায়ের মুখ বাবার গান এইসব মনে পড়ত। মা আমার হাত শক্ত করে ধরেছিলেন। কি মধুর সেই স্পর্শ। এমন উম আর কিছুতে আছে কি? সবই অস্পষ্ট, খাপছাড়া।

আমার মা-বাবা, কারো কোনো ছবি আমার মাথায় আসে না।

কোনো এক শ্রাবণের রাত। বৃষ্টি থেমে গেছে। আসমানের দরজা খুলে চাঁদের আলো নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে। সেই আলোয় ভেসে গেছে সবকিছু। মন কেমন যেন আকুলি বিকুলি করছিল। মনে হচ্ছিল সবকিছু ভুলে গিয়ে নিজেরে শূন্য করে দিই। চিন্তা, প্রশ্ন-উত্তরের কোনো মানে থাকবে না। নানা বৈপরীত্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলাম। তখনই, আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম ছোট্ট মেয়েটিকে। চাঁদের মতো মুখ। চাঁদের মতোই। মায়াবতী।

বললাম, কে গো তুমি?

জোছনা।

খুব মৃদু কিন্তু পরিষ্কার শুনতে পেলাম সেই অস্ফুট স্বর। আমি বোধহয় কান হাত চাপা দিয়েছিলাম। সেই মিষ্টি শব্দটা আমার হৃদয়ের সবখানে ছড়িয়ে পড়ে।

প্রচণ্ড ধাক্কা খেলাম যেন কোনো এক অদৃশ্য দেয়ালে। নিজেকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করছি। বুঝতে পারলাম আমার ছোট্ট বোনটি আমার ভেতরই লুকিয়ে ছিলো। এই বুঝে কোনো আড়াল নাই, সহজেই ধরা দিলো। আমি আবারো ভাবি, আবারো। আমার মা-বাবা ক্রমাগত সেই বোধটি আমার ভেতর ঢুকিয়ে গেছেন, তাকে আমি কখনো অতিক্রম করে আসতে পারি নি। নাকি, এটা সত্য নয়। আমিই সুরুজ, আমিই জোছনা। পরক্ষণে সবকিছু নিস্ফল মনে হয়, যেন অবচেতনে কোনো সংস্কারকে নিজের সাথে বেঁধে রেখেছি। আবার ভাবি, জীবন মানে কি যুক্তি সর্বস্বতা, নৈর্ব্যক্তিকতা এসব? যুক্তি নিজে দাঁড়িয়ে থাকে প্রয়োজনের ওপর আর নৈর্ব্যক্তিকতা তো অলীক কল্পনা। এইসব কি ভাবছি?

আমার নির্মোহ চেতনা ধ্বসে যায় যেন। নিজের সাথে যুদ্ধ করি। ধাবমান পৃথিবীতে কিছু একটা আকড়ে ধরতে ইচ্ছে করে। হঠাৎ অনেকদিন পর আমার বেহেশতবাসিনী মায়ের মুখ ভেসে ওঠে। নিঃসঙ্গ, ক্লান্ত সেই মুখ। আমি তার মতো। হয়ত কিছু একটা জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিলেন। বাবার বৈরাগ্যের অর্থহীনতা, সকল প্রতিরোধ সত্ত্বেও তাকে অলীক সন্তানের দিকে ঠেলে দেয়। দুঃখিনী মা আমার। মা তার বাস্তব জগতকে এমনভাবে দলিত করেছেন, যেখানে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো আমি ক্রমশ তার কাছ থেকে দূরে সরে গেছি। সেটাই কি একটু একটু করে আমার হয়ে গেছে? আমার ক্ষোভে ছিলো, ছিলো হতাশা। আজ চাইলে জোছনাকে অস্বীকার করে সেই অবহেলার প্রতিশোধ নিতে পারি। কিন্তু তাতে কি সেই ক্ষোভে, হতাশা মিলিয়ে যাবে?

জানি না জোছনা নামের মেয়েটি আমার ভেতর কেমনে বসত করে। সে আমার সহোদরা। আমার আমিত্বের প্লাবনে সে ক্রমশ স্থান করে নেয়। আমি একটু একটু করে চুরি হয়ে যাচ্ছি। আমার মায়ের মতো কি? আমার ভেতর স্নেহের আকুলতা টের পাই। জোছনা আমার সাথে কথা বলে। গান শোনায়। সেই গানের সাথে সাথে কুয়াশা মোড়া দুনিয়া রোদে ঝলমল করে ওঠে। তার গলা অবিকল মায়ের মতো। জানি না কেমন করে টের পেলাম। আরো কত যে স্মৃতি ধরা পড়ে। এভাবেই বুঝি মানুষ বন্দী হয় অদৃশ্য শিকলে। এভাবেই বুঝি ইচ্ছেগুলি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মায়ের জোছনাময় জীবনটা ক্রমে বাস্তব হয়ে ওঠে। হ্যাঁ, জীবন মানে মায়া, আর কি।

এক এক সময় বাবার কথা ভাবি। তার কথা ভেবে কোনো থৈ পাই না। অদ্ভূত এক ঘটনায় তার সাথে দেখা হয়। তিনি আমাকে চিনতে পারেন না। তাকে জিজ্ঞেস করি, সংসারে আপনার কে কে আছে? তিনি বলেন, জোছনা মানে একটা মেয়ে আছে। আমি বিস্ময় নিয়ে তার দিকে তাকাই। আমার ইচ্ছে করে তাকে বাবা বলে ডাকি। কিন্তু তিনি ক্রমশ মিলিয়ে যেতে থাকেন। তিনি আমার বিস্ময়ের কিছুই টের পান না। নিজেতে মগ্ন। হাতের বাদ্য যন্ত্রটি বাজাতে থাকেন। গান ধরেন, ও দয়াল…।

আমি পুরোপুরি নিমজ্জিত হই জোছনা নামক বিভ্রান্তিতে। এই সেই মধুর ভ্রান্তি। আমাদের সংসারে কেউ তার থেকে মুক্তি পায় নি। বুঝলাম, সংসার নামক অভূত যন্ত্রটি কিছু না কিছুতে ভর দিয়ে টিকে থাকে। জোছনা নামক অলীক মেয়েটি আমাদের অদৃশ্য সংসারের খুঁটি। হ্যাঁ, সংসার। সেটা অদৃশ্য সংসার। নাকি সকল সংসারই অদৃশ্য। দেখাটা দেখার ছল।

আমি জোছনার হাত ধরি। এতো মমত্ব আগে কখনো কারো জন্য জাগে নি। জোছনাকে বলি, চল বোন, এই আজব দুনিয়া ঘুরে দেখি। জোছনা শুধু মাথায় নাড়ায়।

Comments

comments

2 thoughts on “জোছনা আমার বোন

  1. অনেক সুন্দর লাগল। মন ছুঁয়ে গেল কবি।আপনার প্রতিটি লেখায় কোনোনা কোনো ভাবে দর্শনের ছোঁয়া পায়। ভালো লাগে। শুভ রাত্রি।

  2. দর্শন তো জীবনের ভেতরকার জিনিস। আমরা সবাই কিছু না কিছু দর্শন করে আরামবোধ করি। অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকুন।

Comments are closed.